ফিরোজা বেগম: নজরুলসঙ্গীতের সম্রাজ্ঞী
ফিচার ডেস্ক

ফিরোজা বেগম
এগারো-বারো বছরের কন্যা। কলকাতার এইচএমভি স্টুডিওতে ভাই আর মামার সঙ্গে গানের অডিশন দিতে এসেছেন। রিহার্সাল রুমে ঢুকে সে দেখে ঘি-রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা পরা এক ব্যক্তি বসে। সেই ব্যক্তিই মন দিয়ে তার গান শুনলেন। সেদিন বালিকার নিবেদনে ছিল ‘যদি পরাণে না জাগে আকুল পিয়াসা’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘কালো পাখিটা মোরে কেন করে জ্বালাতন’। রিহার্সাল রুমের সেই ব্যক্তি কন্যাটির গান সেদিন শুনে প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘তোমরা দেখো, এই মেয়ে একদিন খুব ভাল গাইয়ে হবে।’
সেদিন সেই ছোট্ট মেয়েটি ছিলেন ফিরোজা বেগম। আর মেয়েটির মামা পরে মেয়েটিকে জানালেন, যিনি এতক্ষণ রিহার্সাল রুমে বসে তার গান শুনছিলেন তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম! আজ এ হেন শিল্পী ফিরোজা বেগমের চলে যাওয়ার দিন। ২০১৪ সালের এই দিনে তিনি চিরতরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। বিশেষ এই দিনে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
উপমহাদেশের বাংলা সঙ্গীতের প্রতীকীরূপ বলা হয় তাকে। বিশেষ করে নজরুলসঙ্গীতে তিনি এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছেন যে, পরবর্তী প্রজন্মগুলো তাকে অনুসরণ করে চলছে এ পথে। বলা যায়, নজরুলসঙ্গীতের আস্ত একটা প্রতিষ্ঠান তিনি নিজেই।
সঙ্গীতের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক মনের, তারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন কার কথা বলছি। হ্যাঁ, তিনি ফিরোজা বেগম। বাংলাদেশের কিংবদন্তি এই শিল্পী সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় নিজের অনন্য দক্ষতার সাক্ষর রেখেছেন। তবে নজরুলসঙ্গীতে তার অবদান অবিস্মরণীয়। যার ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
১৯৩০ সালের ২৮ জুলাই ফরিদপুরের গোপালগঞ্জের রাতইল ঘোনাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ফিরোজা বেগম। বাড়ির মানুষজন তাকে আদর করে শ্রাবণী ও আনার বলে ডাকতেন। অন্তর্মুখী স্বভাবের হলেও ফিরোজা ছিলেন অসম্ভব মেধাবী।
তিনি সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারের কন্যা। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন তিনি। তাই এই ভুবনেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেন। ফিরোজা বেগম যখন মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন, তখনই তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গান করার সুযোগ পান।
মামার বসবাসের সুবাদে কলকাতায় যান ফিরোজা। তখন তার কণ্ঠভরা সুর, মধুর গায়কি। সেখানে গিয়ে বড়দের সামনে গান করেন, সবাই মুগ্ধ হন। একদিন গুণীজনদের মজলিসে গান শুনিয়ে দারুণ প্রশংসিত হন ফিরোজা। অথচ তিনি তখন জানতেনও না যে, তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান গাইছেন।
১৯৪২ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিরোজা বেগমের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে ৭৮ আরপিএম ডিস্কে তার গাওয়া ইসলামি গানের রেকর্ড বের হয়। যা শ্রোতাদের কাছে প্রশংসিত হয়।
আত্মপ্রকাশের আগেই মাত্র ১০ বছর বয়সে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য পান ফিরোজা বেগম। এমনকি কাজী নজরুল ইসলামের কাছ থেকে গানের তালিম নেওয়া এবং তাকে গান শোনানোর সৌভাগ্যও হয়েছিল তার।
যেই নজরুলসঙ্গীতের জন্য ফিরোজা বেগম বিখ্যাত, সেই সঙ্গীতে তার প্রথম রেকর্ড প্রকাশ হয় ১৯৪৯ সালে। এরপর তিনি আরো বেশ কিছু নজরুলসঙ্গীতের অ্যালবাম প্রকাশ করেন। বলা হয়ে থাকে, তার কণ্ঠে জনপ্রিয়তার পাওয়ার পর থেকেই কবি নজরুলের গান নজরুলসঙ্গীত হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করে।
নজরুল সঙ্গীত ছাড়াও ফিরোজা বেগম আধুনিক গান, গজল, কাওয়ালি, ভজন, হামদ ও নাত-সহ বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতে কণ্ঠ দিয়েছেন। জীবদ্দশায় তার ১২টি এলপি, ৪টি ইপি, ৬টি সিডি ও ২০টিরও বেশি অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়। ফিরোজা বেগম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৩৮০টিরও বেশি একক সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন।
ক্যারিয়ারের প্রায় শুরুর দিকেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন ফিরোজা বেগম। ১৯৫৫ সালে তিনি যখন কলকাতায়, তখন গায়ক, গীতিকার ও সুরকার কমল দাশগুপ্তকে বিয়ে করেন। এরপর ১৯৬৭ সালে তারা ঢাকায় আসেন। তাদের তিন সন্তান তাহসিন আহমেদ, হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদ। এর মধ্যে হামিন ও শাফিন বাংলাদেশের কালজয়ী ব্যান্ড ‘মাইলস’-এর সদস্য।
ফিরোজা বেগম যেমন মন খুলে গেয়েছেন, তেমনই শ্রোতাদের হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা পেয়েছেন। আর পুরস্কার-সম্মাননার দিক দিয়ে তো তার কোনো অপ্রাপ্তি নেই। এক জীবনে তিনি প্রায় সব সম্মাননাই পেয়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি স্বর্ণপদক তার অর্জনের খাতায় রয়েছে।
এছাড়া নেতাজী সুভাষ চন্দ্র পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, স্যার সলিমুল্লাহ স্বর্ণপদক, দীননাথ সেন স্বর্ণপদক, বাচসাস পুরস্কার, সিকোয়েন্স পুরস্কার, সেরা নজরুল সংগীতশিল্পী পুরস্কার (একাধিকবার), শ্রেষ্ঠ টিভি শিল্পী পুরস্কার (পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে), নজরুল আকাদেমি পদক, চুরুলিয়া স্বর্ণপদক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট ইত্যাদি সম্মাননাও রয়েছে তার ঝুলিতে। শুধু তাই নয়, ২০১২ সালের ১২ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ‘বঙ্গ সম্মান’য় ভূষিত হন ফিরোজা বেগম।
কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ফিরোজা বেগম। ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তিনি রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেদিন কেবল ফিরোজা বেগমের দেহাবসান হয়েছিল। আদতে তিনি তো অমর, শ্রদ্ধায় চিরস্মরণীয়।
তার আকাশসম অবদান সঙ্গীত অনুরাগীদের কাছে পথ নির্দেশনা হিসেবে থেকে যাবে। আর তিনি অমর হয়ে থাকবেন সঙ্গীত তথা নজরুলসঙ্গীতের একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান হয়ে।
- ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’
- চার হাত-পায়ে হাঁটেন তারা, বিজ্ঞানীরাও বিস্মিত
- পুরুষ পর্ন তারকারা বেশিরভাগই যে সমস্যায় পড়েন
- প্রাইজবন্ড: কীভাবে কিনবেন, পুরস্কারের টাকা পায় কয়জন?
- হেজাজ যেভাবে সৌদি আরব হলো
- ‘ঈদ সালামি’ যা-ই হোক, হতে হবে চকচকে নতুন নোট
- ময়মনসিংহে বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়লেন তিন হাজার মুসল্লি
- বাসর রাতে বর-বউকে কেন দুধ খাওয়ান?
- গুপ্তচর থেকে রাষ্ট্রনায়ক!
- তারকা খেলোয়াড়রাই কেন বেছে নেন ১০ নম্বর জার্সি