বেনজীরের সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক

নিউজ ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ১২:০২ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ মঙ্গলবার

বেনজীরের সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক

বেনজীরের সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সোমবার বিকেলে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন রাজধানীর সেগুনবাগিচায় সংস্থাটির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।

এর আগে গত রবিবার বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অনুসন্ধান চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান। একই দিন বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল পৃথক দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন দুটি প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে। মূলত এর পরই দুদক বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।

অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।কমিটির অন্য দুজন সদস্য হলেন—সহকারী পরিচালক নিয়ামুল হাসান গাজী ও সহকারী পরিচালক জয়নাল আবেদীন।

দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, গত ৩১ মার্চ সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের একটি প্রতিবেদন একটি জাতীয় দৈনিকে (কালের কণ্ঠ) প্রকাশিত হয়। পরে ১ ও ২ এপ্রিল আরো কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একই ধরনের অভিযোগে খবর প্রকাশিত হয়। এসব অভিযোগের বিষয়ে দুদক বিধিমালা, ২০০৭ এর ৩ নম্বর বিধির আওতায় কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

দুদক আইন, ২০০৪ এর ১৫ নম্বর ধারার বিধান মতে বর্ণিত অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরই গত ১৮ এপ্রিল কমিশনের সভায় বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। দুদক আইন ও বিধি মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে অনুসন্ধানকাজ শেষ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে দুদক সচিব বলেন, ‘দুদকের অনুসন্ধান আইওয়াশ নয়। দুদক সম্পর্কে এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান করবেন।সব কিছুই বিধি মোতাবেক করা হবে।’

জানতে চাইলে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, ‘এর আগেও দুদকের উপপরিচালক পদের কর্মকর্তারা অনেক বড় বড় অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছেন। তবে এই অনুসন্ধান যেহেতু সাবেক এক বড় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, ফলে একজন উপপরিচালক বা সহকারী পরিচালক ইতস্তত বোধ করতে পারে। একজন পরিচালক মর্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হলে ভালো হতো।’

দুদক চেয়ারম্যান বরাবর আবেদনে ব্যারিস্টার সুমন বলেছিলেন, বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক। তিনি ৩৪ বছর সাত মাস চাকরি শেষে পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অবসরে যান। অবসর গ্রহণের পর দেখা গেছে, বেনজীর আহমেদ তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের নামে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন, যা তাঁর বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা, বড় মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। এর মধ্যে ছয়টি কম্পানি, রাজধানীর উচ্চবিত্ত এলাকায় দামি ফ্ল্যাট ও বাড়ি, বেস্ট হোল্ডিংসে শেয়ার, ফাইভ স্টার হোটেল লা মেরিডিয়ান ঢাকার শেয়ার, গোপালগঞ্জের ‘সাভানা ইকো রিসোর্ট’, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ৪১৮ ডেসিম্যাল জমি রয়েছে। এসব সম্পদ বেনজীর, তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের বৈধ আয়ের তুলনায় অনেক বেশি। বেনজীর আহমেদ তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার করে বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পত্তি অর্জন করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে বেনজীর আহমেদ এবং তাঁর স্ত্রী ও দুই কন্যার বিরুদ্ধে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করছি।

গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল কালের কণ্ঠে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ নিয়ে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিস্তর তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

সাভানা ইকো রিসোর্ট

গোপালগঞ্জের সাহাপুর ইউনিয়নের বৈরাগীটোল গ্রাম। নিভৃত এই পল্লীর মাঝে গড়ে তোলা হয়েছে সাভানা ইকো রিসোর্ট নামের অভিজাত ও দৃষ্টিনন্দন পর্যটনকেন্দ্র, যেখানে এক রাত থাকতে হলে গুনতে হয় অন্তত ১৫ হাজার টাকা। রিসোর্টের ভেতরে ঘুরে দেখা গেছে, একই সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর হাতে গড়া আভিজাত্যের অপরূপ মিশেল। বিশাল আকৃতির ১৫টি পুকুরের চারপাশে গার্ড ওয়াল, দৃষ্টিনন্দন ঘাট, পানির কৃত্রিম ঝরনা ও আলোর ঝলকানি। পার ঘেঁষে রয়েছে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স কটেজ। প্রায় এক হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত ওই ইকো রিসোর্টে বিভিন্ন জায়গায় মাটি ভরাট করে বানানো হয়েছে কৃত্রিম পাহাড়। সাগরের কৃত্রিম ঢেউ খেলানো সুইমিংপুলও রয়েছে। রয়েছে উন্নতমানের সাউন্ড সিস্টেমসহ বিশাল আকৃতির কনসার্ট হল। রিসোর্টের নিরাপত্তায় বসানো হয়েছে ‘বিশেষ’ পুলিশ ফাঁড়ি। যাতায়াতের জন্য সরকারি খরচে বানানো হয়েছে সাত কিলোমিটারের বেশি পাকা সড়ক। এই রিসোর্টের মালিক বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবার।

ছয়টি কম্পানিসহ অঢেল সম্পদ

শুধু একটি ইকো রিসোর্টই নয়, পুলিশের সাবেক এই প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তা তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। অনুসন্ধানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের নামে অন্তত ছয়টি কম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে।

এর বাইরে রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোয় রয়েছে বেনজীর আহমেদের অঢেল সম্পদ। দামি ফ্ল্যাট, বাড়ি আর রাজধানীর কাছেই বিঘার পর বিঘা জমি। দুই মেয়ের নামে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা হোটেল লা মেরিডিয়ানের রয়েছে দুই লাখ শেয়ার। পূর্বাচলে রয়েছে ৪০ কাঠার সুবিশাল জায়গাজুড়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি, যার আনুমানিক মূল্য কমপক্ষে ৪৫ কোটি টাকা। একই এলাকায় আছে ২২ কোটি টাকা মূল্যের আরো ১০ বিঘা জমি।

বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট

গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়াল গড় ইউনিয়নের নলজানী গ্রামে ১৬০ বিঘা জমির ওপর বিস্তৃত ভাওয়াল রিসোর্ট। ২০১৮ সালের ৬ এপ্রিল প্রায় ১০৬ বিঘা জমির ওপর এটির যাত্রা শুরু। পরে এতে যোগ হয় আরো ৫৪ বিঘা জমি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই রিসোর্টের বড় অংশ গড়ে তোলা হয়েছে বনের জমি দখল করে। এর জন্য নেপথ্যে থেকে সহায়তা করেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। কারণ, এই রিসোর্টের এক-চতুর্থাংশ শেয়ারের মালিক তিনি।

পাচারের টাকায় বিদেশে সম্পদের পাহাড়

পুলিশের সাবেক আইজিপি ও র‌্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদের দুবাই, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বিপুল বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন পদে চাকরির সুবাদে বিভিন্ন উৎস থেকে অবৈধ উপার্জনের টাকা পাচার করে বিনিয়োগ করেছেন বলে অনুসন্ধানে উঠে আসে। অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বেনজীর আহমেদের দুবাইয়ে রয়েছে শতকোটি টাকার হোটেল ব্যবসা। সিঙ্গাপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগের সোনার ব্যবসা। এ ছাড়া থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় জমি কিনেছেন বলে জানা গেছে।