বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা

যুদ্ধকে না বলুন

নিউজ ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ০৯:২৯ এএম, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ শুক্রবার

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যুদ্ধ কোনো সমাধান আনতে পারে না। টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা। আমাদের অবশ্যই সব ধরনের আগ্রাসন এবং নৃশংসতার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে এবং যুদ্ধকে ‘না’ বলতে হবে।

গতকাল এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএনএসক্যাপ) ৮০তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। থাইল্যান্ডের জাতিসংঘ সম্মেলন কেন্দ্রের (ইউএনসিসি) এসক্যাপ হলে এ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ জাতিসংঘ মহাসচিবের ‘নিউ এজেন্ডা ফর পিস’কে সমর্থন করে বলে বক্তৃতায় শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন। সমস্ত যুদ্ধ, আগ্রাসন ও নৃশংসতা বন্ধ করার জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গাজায় হামলা শুধু হতাহত, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের হতাহতের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। অথচ আলোচনা শান্তি আনতে পারে। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনে যুদ্ধ এবং গণহত্যা চলছে। এটা বন্ধ করতে হবে। যুদ্ধ কোনো সমাধান আনতে পারে না। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর উদ্যোগ ও শাসনামলে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে ‘পার্বত্য  শান্তিচুক্তি’র কথা উল্লেখ করেন, যা জনগণের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিল। তিনি বলেন, আমাদের অবশ্যই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আঞ্চলিক বিরোধ ও উত্তেজনা নিষ্পত্তি করতে হবে। সর্বোপরি জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখন্ডতার প্রতি আমাদের পারস্পরিক সম্মান দেখাতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণ শেষে সংশ্লিষ্ট জায়গায় আইসিটি বিভাগের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন’ পরিদর্শন করেন। পরে সেখানকার বৈঠককক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতিসংঘের আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল এবং এশিয়া ও প্যাসিফিকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইএসসিএপি) নির্বাহী সচিব আরমিদা সালসিয়ান আলিসজাহবানা সাক্ষাৎ করেন। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিশেষ করে আসিয়ানকে মিয়ানমারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, রোহিঙ্গারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে যেন স্থায়ীভাবে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে। তাদের সংকটের উৎস মিয়ানমারে এবং এর সমাধানও মিয়ানমারেই রয়েছে। যতদিন সমাধানটি নাগালের বাইরে থাকবে, ততদিন আঞ্চলিক সংযোগ, একীভূতকরণ এবং সমৃদ্ধির জন্য আমাদের সব প্রচেষ্টা একটি অদেখা ধাঁধা দ্বারা চিহ্নিত হতে থাকবে। আসুন সেই ধাঁধাটিকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে আমাদের প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করি।

শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হাজার হাজার রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশু বাংলাদেশে পালিয়ে গেলে মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেয়। কিন্তু একটি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে এটি এখন বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকটে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর জন্ম নিচ্ছে ৪০ হাজার শিশু। এতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক সেবন ও পাচার, খুন, ছিনতাই, রাহাজানির মতো নানা কর্মকান্ডে তারা জড়িত। এতে পর্যটন শহর কক্সবাজারের পরিবেশ-পরিস্থিতির দিন দিন ক্রমাবনতি ঘটছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারে চলমান সশস্ত্র সংঘাতের প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হচ্ছে। এটি আমাদের অঞ্চলের ভিতরে এবং এর বাইরে মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে। তিনি বলেন, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে তার অভিন্ন শত্রু দারিদ্র্য ও ক্ষুধার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশে ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দারিদ্র্য ৪১ দশমিক ৫১ থেকে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্য ২৫ দশমিক ১ থেকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূর করার বিষয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী।

শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, বিশেষ নজর দেওয়ায় মাতৃ ও শিশু পুষ্টিসহ বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমানে আমাদের অগ্রাধিকার আয় বণ্টন, সম্পদের মালিকানা এবং সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে বৈষম্য মোকাবিলা করা। তিনি বলেন, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে জলবায়ু সংকট, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং আন্তসীমান্ত দূষণ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গড়ে তুলতে হবে। ২০২৫ সালের পরও কপ-২৯-এ উচ্চাকাক্সক্ষী জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্যের জন্য আমাদের চাপ দিতে হবে। আমাদের আন্তসীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনা এবং বায়ুর মানের উন্নতিতে সহযোগিতা করতে হবে। ক্রমবর্ধমান চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলোর জন্য আমাদের সবাইকে প্রস্তুত হতে হবে। দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের আগাম সতর্কতার সক্ষমতার উন্নয়নে আমরা ইউএনএসক্যাপের সহায়তার প্রশংসা করি।

সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি ও অর্জনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়নের বেশির ভাগ অর্জনই জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিম্ন ব-দ্বীপ অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতায় ব্যাপক বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। তিনি উল্লেখ করেন, জলবায়ু অভিযোজনে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বনেতা হিসেবে স্বীকৃত। অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্যগত এবং উদ্ভাবনী সমাধানগুলো ভাগ করে নিতে পেরে আমরা খুশি। বাংলাদেশ এ অঞ্চলের উন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে তাদের সুনির্দিষ্ট সময়সীমার নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে তাঁর সরকার পরিচ্ছন্ন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সুষ্ঠু মিশ্রণে দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে। আমরা একটি বৃত্তাকার এবং নিম্ন-কার্বন-অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথ অন্বেষণে আমাদের কাজ চালিয়ে যাব। তিনি অর্থায়ন ও প্রযুক্তিতে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাত থেকে বর্ধিত ও সহজ প্রবেশাধিকারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর সক্ষমতা গড়ে তুলতে পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন সরবরাহের জন্য আমি ইউএন-এসক্যাপকে আমন্ত্রণ জানাই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং রেলওয়ে নেটওয়ার্কে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ প্রদান করছে। আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সংযোগ বাড়াতে আমাদের ভৌত ও ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাই প্রধানমন্ত্রী স্রেথা থাভিসিনের আমন্ত্রণে ছয় দিনের সরকারি দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় সফরে ২৪ এপ্রিল বুধবার থাইল্যান্ডে গেছেন। ২৯ এপ্রিল সোমবার সকালে ঢাকার উদ্দেশে তাঁর ব্যাংকক ত্যাগ করার কথা রয়েছে।