টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি

নিউজ ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ১০:৩৫ এএম, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ বুধবার

টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি

টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি

মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনীয় সম্পদ সরবরাহ করে, যোগাযোগ ও পরিবহনের অবারিত মাধ্যম হিসেবে, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের বিপুল আঁধার হিসেবে এবং সর্বোপরি বিশ্ব অর্থনীতির বিপুল ভাণ্ডার হিসেবে সমুদ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ঐতিহাসিক ভাবেই বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমুদ্রলালিত জনপদ। বাংলাদেশের হাজার নদীর গন্তব্য সমুদ্র, আমাদের বঙ্গোপসাগর, একটি বৃহত্তম সমুদ্র প্রতিবেশ। বাংলাদেশের বদ্বীপ সমুদ্র আর নদীদের ভালোবাসায় সতত সমৃদ্ধ।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে ‘ব্লু ইকোনমি’-এর অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করে সামুদ্রিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে পরে। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি সুস্বাস্থ্য এবং জীবনীশক্তি নিশ্চিত করে বিশ্বের সাগর-মহাসাগরগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য একটি চমৎকার উপায় টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি। এটি পরিবেশগতভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই এবং সামাজিকভাবে ন্যায়সঙ্গত।

একটি টেকসই সমুদ্র অর্থনীতির মূল উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে সঠিক মৎস্য আহরণ কৌশল অনুশীলন, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, সমুদ্র থেকে নবায়নযোগ্য শক্তির অনুসন্ধান ও ব্যবহার, টেকসই সামুদ্রিক পরিবহন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলোতে উপকূলীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তি। টেকসই সমুদ্র অর্থনীতির লক্ষ্য হলো বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করার জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখা।
ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি বলতে বোঝায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নত জীবন-জীবিকা এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বের জন্য সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই সুষ্ঠু ব্যবহার। মৎস্য, অ্যাকুয়াকালচার, সামুদ্রিক পরিবহন, নবায়নযোগ্য শক্তি, প্রতিবেশবান্ধব পর্যটন এবং সমুদ্র প্রতিবেশ সংরক্ষণসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত।

অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস, দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি ধারণাটি ২১ শতকের শুরুতে প্রাধান্য লাভ করে। এই চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্বের মহাসাগরগুলোকে ব্যবহার করার জন্য আরও ভারসাম্যপূর্ণ এবং টেকসই পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বের প্রায় সব দেশই টেকসই উন্নয়ন ও জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জনে সমুদ্রের তাৎপর্য স্বীকার করেছে।সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে সমুদ্র পর্যবেক্ষণ এবং অধ্যয়ন অপরিহার্য। একটি টেকসই বিশ্ব বিনির্মাণে স্থল ও সমুদ্রের মধ্যে সংযোগকে শক্তিশালী করতে সামুদ্রিক বিজ্ঞানকে মৌলিক গবেষণা এবং অনুশীলনের ক্ষেত্র হিসেবে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। 
বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি বিশাল সামুদ্রিক অঞ্চলের অধিকারী। দেশের সুনীল অর্থনীতির মধ্যে মৎস্য, শিপিং, প্রতিবেশবান্ধব পর্যটন, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অন্তর্ভুক্ত। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত না করে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য এই খাতে টেকসই উন্নয়ন অপরিহার্য। সমুদ্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সমুদ্র বাংলাদেশের মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস। বর্তমানে টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশ্ববাসী সোচ্চার হয়েছে। তাই সুনীল অর্থনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের বিশাল সামুদ্রিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর এখনও সুবর্ণ সুযোগ। 
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতীয় সমৃদ্ধিতে সাগর, মোহনা এবং নদী ব্যবস্থার অসামান্য গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরপরই সামুদ্রিক খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে এবং সমুদ্র বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সমুদ্র সম্পদ অন্বেষণে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া মজবুত ভিত্তিকে পাথেয় করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেকসই উন্নয়ন অর্জনের জন্য সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ভিশন ২০৪১, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ এবং বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ এর মতো চমৎকার উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে অদম্য চেতনা ও দূরদৃষ্টির উদাহরণ আমাদের সামনে রেখেছেন। এ উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে টেকসই সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হবে। 
সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে এবং সুনীল অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করতে ২০১৩ সালে সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের প্রথম মেরিটাইম বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়।

এটি সমুদ্র-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কোর্স এবং প্রোগ্রাম পরিচালনা করে। যেমন- ওশানোগ্রাফি, মেরিন বায়োটেকনোলজি, মেরিন ফিশারিজ, পোর্ট অ্যান্ড শিপিং ম্যানেজমেন্ট, নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, মেরিটাইম ল’ ইত্যাদি। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে সমুদ্রের বিভিন্ন প্যারামিটার এবং সুবিধা সম্পর্কে অবহিত করা এবং উচ্চতর সামুদ্রিক শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিশ্বব্যাপী অন্যান্য মেরিটাইম সংস্থার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কেন্দ্রবিন্দু এই বিশ্ববিদ্যালয়।

টেকসই সমুদ্র অর্থনীতির তাৎপর্য এবং বাংলাদেশের সুনীল প্রবৃদ্ধিকে অগ্রসর করতে টেকসই সমুদ্র অর্থনীতির ভূমিকা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ একটি সেমিনারের আয়োজন করেছে। সেমিনারটি সমুদ্রের টেকসই উন্নয়নের গুরুত্ব অনুধাবন করতে সহায়তা করবে। ব্লু গ্রোথ বা সুনীল প্রবৃদ্ধি উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ২৯ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে ‘টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি: বাংলাদেশের সুনীল প্রবৃদ্ধির অগ্রগতি/Sustainable Ocean Economy: Advancing BangladeshÕs Blue Growth’ শীর্ষক দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজনের এই অনন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সেমিনারটি প্ল্যানারি সেশন এবং প্যারালাল টেকনিক্যাল সেশনে পরিচালিত হবে। জাতীয় সমৃদ্ধির চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে নতুন পন্থা উদ্ভাবনের জন্য বিভিন্ন চিন্তাধারা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করতে দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট বক্তারা সেমিনারে অংশগ্রহণ করবেন এবং বক্তব্য রাখবেন।
একটি টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য অত্যাবশ্যক এবং বাংলাদেশের জন্য এটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করবে। এই সেমিনারের লক্ষ্য বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতকল্পে আলোচনাকে উৎসাহিত করা, অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি, চর্চা এবং সমাধান তৈরি করা, যেন আমরা নিজেদের ও সমুদ্রের জন্য একটি টেকসই এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারি।

এই সেমিনারের লক্ষ্য একটি টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি এবং সুনীল প্রবৃদ্ধির জন্য বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সৃষ্টি, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং অংশীদারিত্বের ভিত্তি তৈরি করা। সেমিনারটি সমুদ্র বিজ্ঞান সম্পর্কে ডেটা এবং তথ্য সরবরাহ করে কার্যকর সমুদ্র অর্থনীতির জন্য কার্যক্রম গ্রহণ ও ন্যায়ের চর্চায় সহায়তা করবে। যা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এর সমর্থনে গড়ে উঠবে এবং যা আমাদের ভিশন ২০৪১-এর লক্ষ্যের সঙ্গেও সম্পৃক্ত থাকবে।