হাওড়া ব্রিজের বিস্ময়কর সৌন্দর্য

নিউজ ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ০৮:২৩ পিএম, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ শুক্রবার

হাওড়া ব্রিজের বিস্ময়কর সৌন্দর্য

হাওড়া ব্রিজের বিস্ময়কর সৌন্দর্য

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখা শেষে রওয়ানা দিলাম আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোড ধরে নন্দনের দিকে। কলকাতার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এই নন্দন। এটি মূলত কলকাতার সরকারি চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। অনেকটা আমাদের শিল্পকলার মতো। নন্দনের লোগোটা ডিজাইন করেছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। কর্পোরেট ঘরানায় আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত ভবন। ভেতরে প্রবেশ করিনি। বাইরে থেকে ঘুরে দেখেছি। মূল গন্তব্য হাওড়া ব্রিজ। পথে যা যা দেখা যাবে দেখে নেব। জয়দীপদা এখানে আমাকে সম্পূর্ণ গাইড করেছে। ভিক্টোরিয়া থেকে অল্প হাঁটার পথ। এখান থেকে হাওড়া পর্যন্ত পুরোটাই আমরা হেঁটে বেরিয়েছি। পাবলিক বাসে ভ্রমণ করার থেকে হেঁটে চলতে আমার স্বাচ্ছন্দ্য লাগে। তাই এ পথ হাঁটতে আমার অসুবিধে হয়নি। নন্দন থেকে আমরা বড়বাজারের উদ্দেশে চলেছি। পথে কয়েকবার বাসে চড়ার কথা জয়দীপদা বলেছিল। কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করেনি দুজনের কারো। হাঁটা পথেই বেশ লাগছে। এ যাত্রায় ধর্মতলা, কলেজ স্ট্রিট আর কফি হাউজে আমার যাওয়া হয়নি। আর দক্ষিণ কলকাতাতে যাওয়ার ইচ্ছে জাগেনি।ঢাকার আধুনিকায়নে যে ক্লান্তিবোধ আমার হয়েছে, তাতে আর নতুন করে দক্ষিণ কলকাতা দেখার সাধ জাগেনি। বড়বাজারে আমাদের দুটো উদ্দেশ্য ছিল, দুপুরের খাবার খাওয়া আর নাখোদা মসজিদ দেখা। এখানে বেশিরভাগই মুসলিম। আর কমবেশি সবাই উর্দুভাষী। পরিবেশ অনেকটা লাহোর, করাচি কিংবা মোটা দাগে বলতে গেলে আমাদের পুরান ঢাকার মতো। দুপুরের খাবারের জন্য জয়দীপদা নিয়ে গেল রয়াল ইন্ডিয়াতে। ১৯০৫ সাল থেকে এই রেস্তোরাঁ। মুসলিমদের পরিচালিত হলেও এখানে গরুর মাংস পাওয়া যায় না। এখানকার বিখ্যাত মাটন চাপ। তাই আগ্রহের সাথে খেতে বসলাম। এই রেস্তোরাঁর মজার বিষয় হলো এখানে আসলেই খেতে বসার সুযোগ নেই। সব সময় ভিড় থাকে। তাই সিরিয়াল দিয়ে ওয়েটিং রুমে বসতে হয়। রেস্তোরাঁয় ওয়েটিং রুম আমি আগে দেখিনি। ভেতরে খালি হলে ওয়েটিং রুম থেকে ডাক পড়ে। আমি আর জয়দীপদা তাই অপেক্ষা করলাম কখন ডাক আসে। এখানকার খাবারও ভালো। দামের তুলনা করলে ঢাকায় রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম কম। কলকাতায় কিছুটা বেশি। কিন্তু কলকাতায় বাকিসব কিছুই কম দামে পাওয়া যায়। খাওয়ার পর নাখোদা মসজিদে গেলাম। কলকাতার প্রধান মসজিদ। মোগল স্থাপত্যের আদলে তৈরি মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯২৬ সালে। বড়বাজারের গলিগুলোতে হাঁটলে অন্যরকম অনুভূতি পাওয়া যায়। যা কলকাতার আর কোথাও আমি পাইনি। সবকিছুই অনেক পুরোনো।

হাওড়া যাওয়ার জন্য বাসে উঠবো কি না দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ভাবতে ভাবতে আমরা অনেকটা পথে চলে এসেছি। এখন আর বাসে না চড়ারই মনস্থির করলাম। হাওড়ায় সকালবেলা ফুলের হাট বসে। কিন্তু আমি যখন আসি তখন বিকেল। তাই এই সৌন্দর্য দেখা হলো না। দূর থেকেই হাওড়া ব্রিজের অবয়ব দেখে অনেকটা পাহাড় দেখার মতোই আনন্দ পেলাম। সঞ্জিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ গল্প পড়ে আমার পাহাড় প্রীতি। দূর থেকে পাহাড় দেখে দূরত্ব অনুমান করা কঠিন। মনে হবে এই বুঝি একটু সামনেই। হুগলি নদীর তীর ঘেঁষে বেশ কিছু স্থাপনা গড়ে উঠেছে। আমরা বুড়িগঙ্গাকে যেভাবে হত্যা করেছি হুগলি নদীকে এভাবে এখনো হত্যা করা হয়নি। হাওড়া ব্রিজের নাম অবশ্য এখন পরিবর্তন করে রবীন্দ্র সেতু রাখা হয়েছে। কিন্তু লোকে হাওড়া সেতুই বলে। পায়ে হেঁটেই সেতু পারাপারের ব্যবস্থা আছে। সেতুটার মূল আকর্ষণ হলো এতে কোনো পিলার নেই। বিশাল বিশাল স্টিলের পাত একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়ে বানানো হয়েছে। সেতুর নিচে দাঁড়িয়ে ওপরে তাকালেই সব দৈত্যাকার স্টিলের পাত চোখে পড়ে। কিন্তু দুঃখজনক হলো সেতুতে থাকা স্টিলের নিচের যে অংশটা রাস্তার সঙ্গে লাগানো তার গোড়ার দিকে প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো। এই উদ্যোগের কারণ বিহারিরা পান খেয়ে পিক ফেলে স্টিলের ওপর। তাতে স্টিল নষ্ট হয়ে যায়। মানুষের এই দুর্দশা দেখে মর্মাহত হলাম। বিস্ময়কর এই সেতুতে এসে কেন পানের পিক ফেলতে হবে!

সেতু পার হয়ে ওপারে গেলেই ভারতে সবচেয়ে বড় রেলস্টেশন, হাওড়া। এখান থেকে ট্রেনে করে পুরো ভারতেই যাতায়াত করা যায়। মূলত কলকাতা এসেছিলাম হাওড়া থেকে ট্রেনে করে আগ্রার তাজমহল দেখার আশায়। কিছুই পরিকল্পনা মতো হয়নি। তবে এ নিয়ে আমার আক্ষেপ নেই। যা দেখেছি তাতে মনের খোরাক ষোলোকলা পূর্ণ।

হুগলি নদীতে ছোট লঞ্চ চলে পারাপারের জন্য। ৬ রুপি করে দুজনে টিকিট কেটে লঞ্চের জন্য অপেক্ষা করলাম জেটিতে। হাওড়া ব্রিজ থেকে একটু দূরেই বিদ্যাসাগর সেতু। হুগলি নদী সোজা চলে গেছে সুন্দরবনে। মিনিট দশেকের নদীপথে যাত্রা করে ওপারে পৌঁছলাম।

এবারের গন্তব্য ইডেন গার্ডেনস। ইডেন গার্ডেনস যেতে রাস্তাটা বেশ সুন্দর। অনেক চওড়া আর মোড়ে পুরোনো বিশাল অশ্বত্থ গাছ। বেশ পরিষ্কার আর শীতল এখানকার পরিবেশ। অনেক পুরোনো এই ক্রিকেট স্টেডিয়াম সবার কাছেই পরিচিত নাম। এর পাশেই রয়েছে আকাশবীণার ভবন, কলকাতা হাইকোর্ট, রাজবাড়ি ও কলকাতা বিধানসভা। এই জায়গাগুলো তুলনামূলক গোছানো এ কারণেই। দিনের আলো যত কমে আসছে; আমার ভ্রমণ ততই শেষ হয়ে আসছে। ময়দানের শহীদ মিনার হয়ে আমরা আবার ফিরে আসি পার্কস্ট্রিটে। এবার নিউমার্কেটের পেছনের পথ দিয়ে প্রবেশ করে। আগের দিন যখন আসি তখন এ পাশটায় আসা হয়নি। এখন এসে বেশ পরিচিত লাগলো। সবই কাছাকাছি দূরত্ব। যাওয়ার পথে কিছু কেনাকাটা করলাম। ঘুরতে এসে কেনাকাটার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু একেবারেই খালি হাতে ফেরাও ঠিক হবে না। কিছু স্মৃতি নিয়ে ফিরতে হবে।

এই পথ এখন আমার বড্ড চেনা হয়ে গেছে। ফেরার পরিকল্পনা শুরু করতে হবে এখন। সারাদিন ঘুরে বেশ ক্লান্ত। সহজে কীভাবে ফেরা যায় সেই চিন্তাই করতে হচ্ছে। মির্জা গালিব স্ট্রিটের পাশেই মার্কুইস স্ট্রিট। এখান থেকে সরাসরি ঢাকার বাস পাওয়া যায়। ফেরার পথে ভাবলাম কথা বলে নেব। বাসে করে সরাসরি ঢাকা আসার দুটো পদ্ধতি। প্রথমত একই বাসে চড়ে আসা, দ্বিতীয়ত পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্তে এসে বাস পরিবর্তন করে ওপার থেকে আরেক বাসে যাওয়া। সরাসরি বাসে এলে ইমিগ্রেশনে বেশি সময় নেয় জানতে পারলাম। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম সরাসরি বাসে যাব না। টিকিট নিয়েছি ১৪০০ রুপিতে। ট্রেনে এলে এর থেকেও অর্ধেক খরচে ঢাকায় ফেরা যেত। কিন্তু এভাবে যাওয়ার মতো ধৈর্য ও মানসিক বল কিছুই পাচ্ছিলাম না।ফিরতে হবে একা। বাস ছাড়বে ভোর ৫টায়। রাতে বাঙালি খাবারের জন্য মন টানলো। কাছেই ভালো মানের রেস্তোরাঁর সন্ধান পেলাম। এখানকার মেন্যুগুলো বেশ। তবে যা বুঝলাম একা খেতে গেলে খরচ বেশি পড়ে। বাসের টিকিট কাটার পর আমার হাতে বাকি শুধু ৬০০ রুপি। এই দিয়ে রাতের খাওয়া এবং আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে হবে। সকালেই বাস। ১২টার মধ্যে চলে যাব বাংলাদেশে। তখন আর রুপির প্রয়োজন পড়বে না।
রাতে খাওয়ার জন্য বাসমতি চালের ভাত আর কচু পাতা দিয়ে চিংড়ি ভাপা নিলাম। খেতে খুব দুর্দান্ত লেগেছে। সবমিলিয়ে ৩০০ রুপির মতো খরচ পড়েছে। কিন্তু মন ভরেছে। গেস্ট হাউজে ফিরে সব গুছিয়ে নিলাম। এ রাতেই বিদায় জানাতে হবে আনন্দের শহর কলকাতাকে। স্মৃতির পসরা নিয়ে ফিরছি।বেনাপোল-যশোর আমার এবারই প্রথম যাত্রা। ইমিগ্রেশনে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি আমাকে। প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণ কেটেছে স্বপ্নের মতো। ইতিবাচক অভিজ্ঞতা আর কিছু সম্পর্কের বাধন নিয়েই ফিরছি। ভাষা আমাদের এক সুতোয় বেঁধেছে। কাঁটাতারের বিভেদ থাকলেও ভাষার টানে আমরা এক। দুই বাংলার আবেগে কোনো বিভেদ নেই। আবার হয়তো আসা হবে ভালোবাসার টানে। ঘরে ফেরার তাড়না এবারই প্রথম অনুভব করলাম। একযুগের বেশি হলো ঘর ছেড়েছি। যাযাবর হয়েই পথ চলেছি। রেহাগোজার হয়েই জীবনের পথ পাড়ি দিতে চাই। কঠিন শিকল হয়তো ভেঙে ফেলা যায় কিন্তু রেশমি সুতার বাঁধন ছিড়ে কখনো বের হওয়া যায় না। পরাধীন জীবনের ঘুড়ি হয়তো মুক্ত আকাশেই উড়ছে কিন্তু নাটাই ঘুড়ির হাতে নেই। হে জীবন, যদি কিছু হতে চাও তবে মুক্ত বিহঙ্গ হও। রঙিন ঘুড়ি হইও না। তবে বাঁধা পড়বে রেশমি সুতোর বাঁধনে।