ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

একজন অনুবাদকের গল্প

ফজল হাসান

প্রকাশিত: ১৩:১৫, ২৮ জানুয়ারি ২০২৩  

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

আমি পেত্রার উদ্দেশ্যে এথেন্স ত্যাগ করি; কোথায় যাব, তার ঠিকানা আমার সঙ্গে ছিল। আমি যখন গন্তব্যে পৌঁছি, তখন আরেকজন শরণার্থী এসে আমাকে একটা বাড়িতে নিয়ে যায়। আমরা ঠিকানার কাছাকাছি পৌঁছানোর পর সে চারপাশে ইতিউতি তাকিয়ে দেখে কোনো পুলিশ আমাকে অনুসরণ করছিল কি না। সে আমাকে বলেছিল যে, নিরাপদে থাকার জন্য আমাদের কোথায় যেতে হবে। আমরা একটা ভাঙা বাড়িতে লুকিয়ে ছিলাম; বাড়িটা দেখে মনে হয়েছিল যে, অনেক দিন ধরে খালি পড়ে আছে। দিনের বেলায় সেখানে কেউ আসা-যাওয়া করে না, কিন্তু রাত হলেই কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে।


দ্বিতীয় রাতে কেউ একজন ডেকেছিল—
‘অরেঞ্জ গেম খেলার জন্য কে তৈরি আছেন?’
‘অরেঞ্জ গেম’ হল অবৈধ কাজ; উদাহরণস্বরূপ, সীমানা অতিক্রম করা, রাতের খাবারের সময় দু’জনের খাদ্য নেওয়া, হয়তো চুরি করে। এসব আমি দীর্ঘ পথ চলার সময় শিখেছি এবং মোরিয়া শরণার্থী শিবিরে অসংখ্যবার শুনেছি। শরণার্থীদের মধ্যে এটি সাধারণ বাক্যাংশ এবং তারা সবাই এর অর্থ জানে।
সুতরাং আমি ভেবেছি: এটা মজার হবে যদি আমরা গ্রীস থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে একটি ট্রাকে করে যাই, যা কমলা বহন করে! আমি আগেই শুনেছি—মানুষ ইতালিতে যাওয়ার জন্য যে কোনো ধরনের গাড়ি ব্যবহার করে।
তৃতীয় রাতে চোরাকারবারী বলেছিল—
‘তৈরি থাকুন! আজ রাতে আমাদের খেলা হবে—আসল খেলা! আপনাদের ইতালিতে পাঠানো হবে!’
চোরাকারবারীরা সংখ্যায় পাঁচজন, যারা কমলা নিয়ে ইতালিতে যাওয়ার জন্য ট্রাকের হদিশ পেয়েছে।
খামারের কাছেই ট্রাক থেমে ছিল, যেখানে আমাদের দেখার মতো কেউ ছিল না 
আমরা আনুমানিক ৪০ বাক্স কমলা তুলে নিয়েছি এবং সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। আমরা দশ জনের বসার জন্য ছোট্ট একটা জায়গা তৈরি করি—এক মিটার প্রশস্ত, দুই মিটার লম্বা এবং ৭০ সেন্টিমিটার উঁচু। আমরা এক বোতল পানি, কিছু খাবার, প্রস্রাব করার জন্য একটা বোতল পেতে পারতাম; ইতালিতে পৌঁছুতে তিন দিন লাগবে।
আমরা ট্রাকে তিন অথবা চার ঘন্টা ছিলাম এবং চুপচাপ অপেক্ষা করেছি। একসময় চালক আসে এবং ট্রাক চলতে শুরু করে। প্রত্যেকেই ছিল চিন্তিত, উত্তেজিত, উদ্বিগ্ন এবং সুখী। আমরা খুবই আস্তে করে এবং সতর্কতার সঙ্গে কথা বলছিলাম। ইতালিতে পৌঁছানোই সবার ইচ্ছা এবং আশা। আমাদের মধ্যে কেউ একজন বলছিল, ‘দয়া করে কথা বলবেন না এবং আপনাদের ফোন সাইলেন্টে রাখুন।’ অন্য আরেকজন বলছিল, ‘আরাম করে বসার জন্য একজন আরেকজনকে সাহায্য করুন।’ কেউ আবার মশকরা করছিল, ‘কেউ গ্যাস ছাড়বেন না। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে!’ আমি শুধু আশা করছিলাম; যা ঘটেছে, তা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।  
আমাদের ট্রাক ঘন্টার পর ঘন্টা চলেছে, কিন্তু আমরা কখনই জাহাজে পৌঁছাতে পারিনি।
আমাদের মধ্যে দুঃশ্চিন্তা বাড়তে থাকে এবং হয়তো চার ঘন্টা পরে আমরা বলাবলি করি, ‘না, এ ট্রাক ইতালি যাচ্ছে না।’ কেউ একজন বলল, ‘হয়তো প্রথমে তিরানা যাবে এবং তারপর ইতালি।’ কিন্তু আমরা তুরস্কে যাওয়ার ঝুকি নিতে পারি না।
ট্রাক থামানোর জন্য আমরা করাঘাত এবং চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করি। চালক ট্রাক থামায় এবং দরজা খোলে। সে লক্ষ্য করে যে, আমরা সবাই শরণার্থী এবং সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে পুলিশ ডাকে। 
আমরা যখন পুলিশ দেখলাম, তখন সবাই বললাম, ‘খেল খতম; পুলিশ যেভাবেই হোক আমাদের এথেন্সে পাঠাবে।’ আমি দীর্ঘ সময় আটক থাকতে চাইনি। আমি নিজেকে বললাম, ‘ধুত্তরি।’ তারপরও আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছিলাম এবং এমন ভাব করার চেষ্টা করেছিলাম যেন কিছুই হয়নি।
শেষ পর্যন্ত আমরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পুলিশ স্টেশনে এক রাত কাটিয়েছি। ছয় জনকে ছেড়ে দিয়েছিল এবং বাকিদের বন্দি হিসাবে অন্য কোথাও ডিটেনশন কেন্দ্রে আটকে রাখা হয়েছিল। আমরা চারজন এথেন্সে যাওয়ার বাসের জন্য তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করেছি। 
পুলিশ হেফাজতে থাকার সময় আমাদের প্রচুর মজা হয়েছিল; কাগজ কেটে আমরা তাস বানিয়েছি, ডিসপোজেবল খাবারের থালাবাসন দিয়ে বল তৈরি করেছি … যখন এথেন্সের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার দিন এলো, তখন আমাদের মোন্ডালিসিয়া নামের এক বন্ধ শরণার্থী শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আয়তনের দিক থেকে মোন্ডালিসিয়া শরণার্থী শিবির ছিল বিশাল বড় এবং কঠোর নিরাপত্তা ছিল। সেখানে অনুমতি পাওয়া যে কেউ পরিবারসহ, একলা, অপ্রাপ্তবয়স্ক থাকতে পারত, এমনকি অসুস্থ শরণার্থীদের থাকার ব্যবস্থা ছিল।  
তবে তিন সপ্তাহ পরে আমার মতো অন্যদের সঙ্গে আমাকে লেসভসে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল এবং তারপর আমাদের মোরিয়া ডিটেনশন কেন্দ্রে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।
এ১-এ জীবন
মোরিয়া ডিটেনশন কেন্দ্রের দুটি অংশে আনুমানিক দুই শ’ শরণার্থী রয়েছে। কেন্দ্রটি অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং চারপাশে বৈদ্যুতিক তারের বেড়া ও বারোটি কন্টেইনার দিয়ে ঘিরে রাখা রয়েছে। আমি কক্ষ নম্বর এ১-এ ছিলাম। এ১-এ পনেরজন লোক ছিল এবং সবাই বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে: আফগানিস্তান, আরব এবং আফ্রিকার নানান দেশের মানুষ।
আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ শরণার্থী ছয় মাসের অধিক সময় ধরে আছে। তাই আমরা একে অপরকে খুব ভালোভাবে জানতাম।
ডিটেনশনের জীবন হল দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে অনেক কিছুই শেখা যায়, যা অন্য কোথাও শেখা যায় না। তবে শেখার বিষয়টি নির্ভর করে আপনি কে, নিজেকে কিভাবে দেখেন, পুরো পরিস্থিতি এবং আপনার সঙ্গে বসবাসকারী অন্যান্য শরণার্থী।
আপনি শুধু নতুন ভাষা, চিত্রাঙ্কন অথবা এমনকি ট্যাটু করার বিদ্যা অর্জণ করবেন না, বরং আপনি নতুনভাবে মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করা শিখবেন এবং ধৈর্য্যশীল হবেন। এসব কিছু মানুষকে আগের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান ও চটপটে করে তোলে। মানুষ যখন বন্দি জীবনের কষ্ট উপলব্ধি করে এবং তারা কোনো ভুল বা অপরাধ করে, তখন এই হল সেই জায়গা যেখানে পুনরায় তারা নিজেদের কার্যকলাপ ভাবতে পারে এবং ভবিষ্যতে কি করবে বা কি করবে না, তা খুঁজে পেতে পারে।
আমি নিজে বিষয়টি এক নেশাখোর বন্ধুর মধ্যে দেখেছি। সে অনেক কষ্টভোগ করেছে। সুতরাং আমার বন্ধুর কাছে নিজেকে শুধরানোর ভালো সময় এবং নতুন করে জীবন গড়ার অপূর্ব সুযোগ ছিল। অন্যদের সাহায্য নিয়ে সে হিরোইন নেওয়া বন্ধ করেছে। সে প্রথম দিন অসুস্থ ছিল এবং সারাক্ষণ বলেছে, ‘আমার শরীর টিপে দাও এবং ঘুমের ঔষধ দাও।’ আমরা তাই দিয়েছি এবং সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কয়েকদিন সাহায্য করেছি। মানসিকভাবে ভারমুক্ত থাকার জন্য আমরা চেষ্টা করেছি এবং সেই লোকের সঙ্গে কথা বলতে সুযোগ দেইনি, যে লোক তার কাছে, এমনকি ডিটেনশন কেন্দ্রের অন্যান্য নেশাখোরদের কাছে হিরোইন নিয়ে আসত। অবশেষে ডাক্তার বা ঔষধপত্র ছাড়াই আমরা সফল হয়েছি। 
আপনারা এখন যা পড়ছেন, তা আমি ডিটেনশন কেন্দ্রে থাকার সময় লিখতে শুরু করেছি।
সবাই জানে যে, ডিটেনশন কেন্দ্রের লোকজনের সমস্যা আছে। এটা স্বাভাবিক—কারাগারের ভেতরের মানুষেরা বাইরের মানুষের মতো ব্যবহার করে না। বিষয়টি সত্যি, তবে বিশেষ করে যদি কারোর মানসিক কোনো সমস্যা থাকে। ডিটেনশন কেন্দ্রের ভেতর মানসিকভাবে সুস্থ থাকাটা খুবই কঠিন এবং সেখানে বেশিরভাগ মানুষ অল্প-বেশি মানসিক সমস্যায় ভোগে। ডিটেনশন কেন্দ্রের ভেতর সব সময় অত্যন্ত কোলাহলপূর্ণ থাকে এবং ভীষণ হৈচৈ হয়। কেউ কেউ উচ্চস্বরে গান শোনে এবং মাঝে মাঝে একজন আরেকজনের সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। 
ম্যামো প্রতিদিন কয়েকবার শব্দ করে প্রার্থনা করে—সে তার সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে বাক-বিতন্ডা করে। সে অনুযোগ করে তার জীবনে কি ঘটেনি, অথবা খারাপ কিছু যা ঘটেছে। সে প্রার্থনার সময় বিভিন্ন ভাষা ব্যবহার করে। আমরা তাকে নিঃশব্দে প্রার্থনা করার জন্য বলেছি, কিন্তু সে বলেছে, ‘না, জোরে বলাই শ্রেয়।’
আর আমরা বলেছি: ‘ওহ, হ্যাঁ, কারণ ঈশ্বর তাহলে তোমার কথা শুনতে পারবেন!’
সে নিজের সঙ্গে একই কথা বলছিল, যারা তাকে দুঃখ দিয়েছে। সে সবাইকে অভিসম্পাত দিয়েছিল এবং তাদের খারাপ কিছু ঘটার জন্য ইচ্ছে করেছিল।
এসব গল্প শোনা খুবই বিরক্তিকর, যা আমরা ইতোমধ্যে এক শ’ বারের মতো শুনেছি। মাঝে মাঝে সে যখন ভীষণ সরব হয় এবং থামতে চায় না, তখন আমরা তার সামনে যাই এবং হুমকি দিয়ে বলি, ‘এখন যদি না থামো, তবে আমরা তোমাকে আঘাত করব!’ বেশিরভাগ সময় কাজ করে এবং সে মুখ বন্ধ রাখে।
তবে সর্বোপরি আমরা শান্ত থাকার এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। আমরা আফগান দল; পাঁচজন ছিলাম এবং সবাই পরিবারের মতো থেকেছি। আমরা একজন আরেকজনকে সাহায্য করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আমি লিখতাম: আমি শরণার্থী সেবা-সংস্থা এবং আইনজীবীদের কাছে চিঠি লিখেছি। সেসব চিঠির বিষয় ছিল সহযোগিতা চেয়ে আবেদন এবং প্রতিটি বিষয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানানো। সেসময় একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকা ভালো ছিল। আমরা একজন আরেকজনের ময়লা কাপড়চোপড় ধুয়েছি, একসঙ্গে খেলেছি, হাসি-তামাশা করেছি, নেচেছি এবং গল্প করেছি। সেখানে আমরা কিভাবে একসঙ্গে মিলিত হয়েছি, সেই গল্প এবং অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছি। আমরা নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনাকে দূরে সরিয়ে রেখেছি, পরস্পরকে উৎসাহ দিয়েছি এবং অতীতের ভালো বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। 
আমাদের যা কিছু ছিল, তাই আমরা দলের সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করেছি। 
সপ্তাহে একদিন বাজারের লোক আসত এবং আমরা আমাদের প্রতিদিনের খাবারের জন্য শাক-সবজি ও মশলাপাতি এবং ঝুড়ি ভর্তি প্যাকেটের জিনিসপত্র কিনতাম। আমরা টাকাপয়সা জড়ো করতাম এবং প্রত্যেকে যে যার সাধ্যমত অংশীদার হত।
যাদের কাছে অর্থকড়ি ছিল না, তাদেরকে বলতাম, ‘ভাই, নিজেকে ছোট মনে করো না।’
কখনো কখনো আমরা পাঁচজনে একটা সিগারেট ভাগাভাগি করেছি। প্রত্যেকের ভাগে কতটুকু, তা বোঝানোর জন্য মজা করে সিগারেটে আমরা ছোট্ট চিহ্ন দিতাম। সুতরাং প্রত্যেকেই সমান ভাগ পেত।
আমার মনে আছে প্রথমদিকে ব্যাপারটা কেমন লাগত: আমার কাছে বড্ড অদ্ভূত লাগত, হতাশ হয়েছি এবং হাল ছেড়ে দিয়েছি।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়