ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কবিতা: মহাভাষ্যের বলয় থেকে

শিবলী মোকতাদির

প্রকাশিত: ১৪:২৮, ২৭ এপ্রিল ২০২৩  

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

খানিকটা ঝোপঝাড় পেরিয়ে অড়হর ক্ষেতের পাশে বসে আছি, আটকানো বন ও বুনো গন্ধের তেলেসমাতিকে সঙ্গী করে। এই ঋতু বসন্তের বারামখানায় গরমে আমি চাই শ্রাবণের শরমে কিছুটা শান্ত হতে। অথচ হুট করে মগজের মোকামে কেন এসে ধরা দিলো দূরের সাইবেরিয়া? কবির ভাবনা, কবির পরিভ্রমণ এমনটাই। কেন যে এত এত জাম্পকাট করে তার চিন্তার, বোধের চিকন তন্তুগুলো। সে বুনে চলে এক অর্বাচীন জাল। তাতে এমনই সূক্ষ্ম ফাঁদ; কে তাতে আটকা পড়বে, কে যাবে ছুটে। কবি কি নিজেই জানেন কিছু তার ভাবকল্পের হদিস?

এমনটা হয়। স্থানিকতা ভেদ করে, ভেঙে ভেঙে টুকরো খণ্ডে ভেসে যেতে হয় মহাভাষ্যের বলয় থেকে। ছায়া আর রোদেলা রঙ্গমঞ্চে ব্যক্তিগত সঞ্চয়ে জমা পড়ে সাহিত্যের সাবস্টেশন থেকে ঝরে পড়া কত না কবি ও কাব্যের মহাজন। আমি অনুভব করি। ক্ষয়ে যাওয়া পারদের আয়নায় দেখি তাদের মুখচ্ছবি। একেবারে স্পষ্ট। দৃঢ় আর সংকল্পময়। ভূপ্রকৃতির গিরিখাত থেকে তারা উঠে আসে। আমাকে চমকে দিয়ে ক্ষয়িষ্ণু বর্ণমালার অমৃতকণায় তাদের মৌলকণাগুলো আমি ধীরে ধীরে আয়ত্তে এনে ভুরুর বাড়ন্ত চুলে চোখ ঢেকে নিভৃত নয়নে পাঠ করি। এই যে ইনি, আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, তাসখেলার মারপ্যাঁচ দেখার লোভে—আমাকে কেন্দ্র করে ঘুরঘুর করছেন। সব উপাধি বাদ দিয়ে আমি বলব এক নির্ভেজাল কবি—আশির দশকে ভুবনের আলো-বাতাসের স্পর্শে এসেছিলেন কবি মজিদ মাহমুদ।

কবিমাত্রই থাকতে হয় তার নিজস্ব স্বকীয়তা। তো প্রশ্ন জাগে, মজিদ মাহমুদ আশির একটা নিজস্ব স্বকীয়তা ধারণ, প্রকারন্তরে তার কাব্যে আনার চেষ্টা করেছেন। এটা মিথ্যা নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, রাষ্ট্র-সময়-সমাজ হুতুমপ্যাঁচার মতো জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থাকে, থাকবে—শুধু এই কারণে যে, যার মধ্যেই স্বকীয়তার লক্ষণ ধরা পড়ে, তাকেই তারা ইন্ডিকেট করে। কেননা, তারা আইমিন একটি গোষ্ঠী, গোত্র মনে করে তাদের কনভেনশনাল চর্চা বোধ হয় তাতে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। ফলে, ভয় এবং সংস্কার থেকেই সবাই তাকে চেপে ধরে। থামতে বলে। দিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। মজিদ মাহমুদের কবিতা প্রেম-রোমাঞ্চ আর দ্রোহের নির্ভেজাল এক ককটেল। কমবেশি সবাই জানি আমরা। আমার মনে হয়, এর বাইরে তিনি অন্য একটা দোলাচল, বলতে গেলে লোকাচার প্রাধান্য দিয়ে টেনে এনেছেন গ্রামীণ লোকশিল্পকে। আধুনিকতার বৈতরণী পার হতে যেমন আমরা নগরায়নকে বেশি বেশি সাপোর্ট করি। ঘুরেফিরেই নগরায়নের ভাবনা নিয়েই আমরা আলুলায়িত হয়ে থাকি। মনে হয়, মজিদ সেই পর্দাটা হটিয়ে আড়ি পেতেছেন আমার বিশুদ্ধ বাংলার মনোজগতে।

কবিতায় স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণ—সে সত্যিই দুরূহ ব্যাপার। অনেক প্রথিতযশা কবি সারাজীবন সাধনা করেও এর সন্ধান পান না। কাব্যে শব্দ প্রয়োগের অভিনবত্ব আর এমন এক ভাষা-নির্মাণ যার শব্দ-বিন্যাসে কবির স্বাক্ষর থাকাটা জরুরি মনে হয়। কিন্তু সেটা চাইলেই তো আর পাওয়া যায় না! সম্প্রতি কবিতা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এটা একেবারে নতুন কিছু নয়। সেই আদ্যিকাল থেকেই চলে আসছে এর ধারা। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে কবিতা যদি কবিতা না হয়ে, হয়ে ওঠে অত্যাচারের শামিল তাহলে বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন এসে দাঁড়ায় পাঠকের সামনে। আসলে প্রতিটি শব্দের একটি বৈচিত্র্যময় বর্ণমণ্ডল থাকে, তারা যখন পাশাপাশি কবিতায় বসে তখন সেই বর্ণমণ্ডলের বর্ণবৃত্ত অন্য বর্ণবৃত্তের সঙ্গে অন্তর্ছেদ ঘটিয়ে এক সূক্ষ্ম, অনুভবে লালনযোগ্য অর্থময়তার জন্ম দেয়। আর তখনই অনুচ্চারিত সেই ভাবনা-ধারণা পাঠককে অন্য জগতের উত্তুঙ্গ আকাশ-শিখরে নিয়ে যায়। যেতে বাধ্য।

আশির এই কবি—মজিদ মাহমুদ কবিতার কাছে দায়বদ্ধ। কবিতায় তার গম্ভীর ও গাঢ় উচ্চারণ, সংস্কৃত শব্দের বাহুল্যে জর্জরিত জ্যেষ্ঠ কবিদের সেইসব প্রবণতাকে ভেঙে নিজের কণ্ঠস্বর তৈরির তরিকায় মেতেছেন। তবে পেরেছেন এ উচ্চারণ, বাহবার বাতাসার ডালি না হয় আমরা পরেই দেবো। সন্দেহের তীর এখনো তাক করা থাকল। ভবিষ্যৎ তাকে কী মাল্য উপহার দেয়? তবে এটা নিশ্চিত তার কবিতার বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো। উচ্চারণে আছে অনায়াস সাবলীলতা। মনে হবে গোড়া থেকেই পাকা কলম নিয়ে হাজির হয়েছেন তিনি। তার মনের ঔজ্জ্বল্যে, মননের যত্নে এবং প্রশ্নময় আত্মসচেতনতায় তিনি নির্মাণ করেছেন তার কবিতা। তার বোধ ও আর্তনাদ গভীর থেকে উঠে আসা নৈরাশ্য একে একে দানা বেঁধেছে। আর এর-ই ঝাঁঝ এসে লেগেছে তার এ যাবৎকালে লেখা আলোচ্য কবিতাগুলোয়।

অনেকটা মিতবাক কবি মজিদ মাহমুদ গুপ্ত কাব্যরচনার কাল ও কাব্য ইতিহাসের নানা যুগসন্ধিক্ষণের সাক্ষী। তিনি একটু একটু করে এক বিস্তৃত ক্যানভাসে মূলত যাপিত সময়ের ছবি এঁকেছেন। যাতে মিশে আছে তার আত্মমগ্ন ললিতকলামাধুরী। সময়ের পিঠে সময় গড়িয়েছে, পাবনা থেকে রাজধানী ঢাকায় থিতু হয়েছেন। মজিদ আজ স্বীকার করতে বাধ্য হবেন—বিশেষ কোনো শহর বিশেষ কাউকে কবি বানাতে পারে না। এ হল চকমকি পাথর। যেখানেই ঘষবেন, স্ফূলিঙ্গ তার স্পষ্টত বোঝা যাবে। আলো এক জটিল রসায়ন। বৈজ্ঞানিক সত্য হলো এই, আলো স্বয়ং অদৃশ্য, প্রতিফলিত হয়ে বস্তু বা বস্তুসত্তাকে দৃশ্যযোগ্য করে তোলে। প্রকৃত কবির কবিতায় যে আলো ছড়িয়ে থাকে সে আলোর প্রকৃতিও সব কবিতায় সমগুণসম্পন্ন হয় না। প্রতিটি কবিতার আলোর প্রকৃতি ভিন্ন। তো মজিদ মাহমুদের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটা অতি স্বাভাবিক। কবি তার জাগতিক সৌন্দর্যকে একান্তভাবে আত্মস্থ করেও কোথায় যেন সংশয়াতুর। জীবনের কঠোর বাস্তবতা, চলতি পথের ধুলোকাদা, কাঁটা তাকে ব্যথাদীর্ণ করে। এই যে দিশাহীন সময়, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শাসনের পতন, মূল্যবোধের ক্রমিক অবক্ষয়, মানুষের বিকলাঙ্গ গুণের বিকাশ, জীর্ণ আদর্শবোধ, মানুষের মলিন মুখ, তাদের ফ্যাকাশে রং আর ফেলে আসা জীবন তার কবিতায় বারবার ছায়া ফেলেছে।

বাংলাকে কেন্দ্র করে মূলত দুদেশেই প্রথাগত ছিলমারা কবিতার কারিগর ছিল তো অনেক। তারা ধমক আর ধার্মিকতায়; শাসনে শোষণও করেছে কবিতাকে নিজস্ব গতবাঁধা ছক আর ছাঁচে। অবশ্য ঘোরতর বর্ষায় আগুন যে জ্বলবে তার লক্ষণ মাঝেমাঝেই ঝিলিক দিচ্ছিল, বিশেষত আশির উল্লেখযোগ্য বেশকিছু গুণমুগ্ধ কবির কবিতার দেহে। তার সামান্য ছিটেফোঁটা আঁচ পাচ্ছিলাম আমরা কেন্দ্র থেকে অনেকটা ঝাপসা কুয়াশাচ্ছন্ন গ্রাম্য-বাতায়নে বসে।

মূলত এমনই টালমাটাল, ইতস্তত, অস্থির, দিকভ্রান্ত আশির দশকে এসে সেই কবি—মজিদ মাহমুদ একান্তই ব্যক্তিগত সাহসী সৌকর্যে কবিতায় রূপান্তর ঘটিয়ে দিয়েছিলেন; তার ‘মাহফুজামঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে। এ-কথা শত্রুকেও মানতে হবে একবাক্যে। নানান দিক থেকে সে-দশক আকুপাকু করছিল মুক্তির মন্ত্র ছড়াতে। দু’তীরেই বিচিত্র জটিলতা, ভয়, ভাবনা, অস্থিরতা বিরাজ করছিল। কথিত সমগ্র রীতিকে পাল্টাতে বদলাতে মরিয়া ছিলেন অজস্র সাধু ও সন্তগণ। ধোঁয়াও উড়ছিল খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে। ধোঁয়া মানেই নিভে যাওয়া নয়। ধোঁয়া ধাপ করে জ্বলে ওঠারও পূর্বসূত্রধারী। আর সে আগুনের ঝড়, ঝঞ্ঝার ধাক্কা এসে লেগেছিল বাংলার কেন্দ্রে, বিভাগ হতে শহরে, শহরের উপকণ্ঠে। বলতে দ্বিধা নেই কখনো শ্রদ্ধা-ভক্তিহীন, প্রায় জাত-পাতহারা ভালসুন গ্রাম্যগৃহের ভেতরে। হারিকেনের জন্ডিসী আলোয়, কখনো কুপিকে কেন্দ্র করে অচেনা মজিদ মাহমুদকে পড়েছি আমি। অনেকটা গোপনে। গুপ্তব্যাধির মতো সুস্থ-সবলকে পাশ কেটে। এ-ও এক ব্যাধির অবতারণা হয়তো।

আসল কথা হলো, একজন সত্যিকারের প্রজননক্ষম প্রতিভা সমাজ ও সময়ের গতিহীন জাড্যতায় কখনোই আবদ্ধ থাকতে চান না। বোধ করি তারা তা পারেনও না। এর মূল কারণ হতে পারে, একজন কালোর্ত্তীণ স্রষ্টা চলিষ্ণু সময় চরিত্রের চেয়ে নির্ঘাত অগ্রসরমান। সময় তার মনন-প্রজ্ঞা-চেতনাকে কোনোভাবেই গণ্ডিবদ্ধ করতে পারে না। কবি মজিদ মাহমুদ এর পারফেক্ট উদাহরণ। তিনি জানেন কবিতা লেখাও অন্যান্য সামাজিক ও সাংসারিক কর্মকাণ্ডের মতোই স্বাভাবিক। যা বলার তা বলে দিতে হয়। অকপটে। কোনোভাবেই তাকে সংক্ষিপ্ত করার এখতিয়ার নেই। না কবির, না তার আত্মার। যতই তুমি টলে পড়ো, এ ঘর থেকে ও ঘর করো। তাকে চিনতে হলে পরিশ্রম করতে হয়। অভিমানে দূরে নয়, বরং কাছে টানতে হয়। শব্দমালার অধীনে থেকে প্রতিমুহূর্তে তাকে প্রদর্শনযোগ্য করতে হয়। রহস্যের অতল স্পর্শ করতে হয়। তাকে আসার জন্য হাঁ করে খুলে রাখতে হয় সব দুয়ার। শ্রদ্ধায় নিমজ্জিত হতে হয় অচেনা অনিশ্চয়তায়। একটি শব্দের জন্য হতে হয় ক্ষরণকামী। অবশ্যই নিষ্ঠাবান ও স্বপ্নবাজ এই কবি সেসব করেন বা করে থাকেন। জীবনের অনেক অনেক সংঘাতকে যুক্তিসঙ্গত রোধ করতে না পারলেও মসৃণ করার লক্ষ্যে হাজার কোলাহলের মধ্যে থেকেও মজিদ চেয়ে থাকেন প্রজাপতিদের উড়ে যাওয়ার দিকে।

কবিতার মধ্যে থাকে ভয়ংকর রকম শুভঙ্করের ফাঁকি। সত্যভ্রমের এই খেলাতে তিনিই পারফেক্ট—যিনি তার কল্পনার আঁচড় দিয়ে পাঠকের দিলের মধ্যে হুটহাট ঘটাতে পারেন জগতের চেনা-অচেনা, দেখা না-দেখার নানান সব ম্যাজিক সন্ত্রাস। কবি মজিদ মাহমুদ তেমন-ই একজন কবি। সহচর। তাকে পাঠ করার বহু বছর পর প্রথম দেখা ও কথায় বুঝেছিলাম কবিতার জন্য ব্যক্তি ও কবি-জীবনে চরমতম লাজুক এই মানুষটির মধ্যেও কী রকম ঘোর আর ঘূর্ণির ওঠানামা। তার ভাষ্যে—মগজের মধ্যে কে যেন হূল ফোঁটাচ্ছে। সারাবেলা, উপর্যুপরি। বলছে দীক্ষা নাও। সৎ আর সত্য হও। সমস্ত সত্তাকে ঢেলে দিয়ে আসো আত্মার কাছাকাছি। ঘুমিয়ে আছে যে জন, আছে এক-ই মুগ-মসুরের ডাল নিয়ে; তাকে ভাব দাও। ভাষা দাও। করো তাকে উজ্জীবিত। স্পেস আর টাইমের সতত যাতাকল হতে তাকে এমন কিছু সঞ্জীবনি সুধা দাও সে যেন নতুনের দিকে তার মুখ ফেরানোর অভিলাষ পায়।

কবি মজিদ মাহমুদ পেরেছিলেন। আমরা জানি, চলমান সমাজ-জীবনের বিবিধ প্রেক্ষাপট, ঘটমান বাস্তবতার নিরিখেই সুখের পাশাপাশি অজান্তে মনের গোপন মানচিত্রে জমতে থাকে ক্ষরণ, তথা শোকের বিন্দু বিন্দু কণাগুলো। অন্যের কী হয় জানি না। তবে এ বেদনা, শোকের স্রোত থেকেই একজন কবির মধ্যে তৈরি হয় এক ধরনের রস। যা করুণাক্রান্ত। যার পাঁচন-প্রক্রিয়ার শেষ ভাগে এসে জন্ম নেয় শ্লোক। সৃষ্টির উপজীব্য মহান সব শুভ্রকথন। কবি মজিদের বেলায়ও ঘটেছে কি তাই? একটু সন্দেহ হয়। যদিও দুঃখের দুয়ার চেনা অতীব দুরূহ, বলা চলে দূর-অন্ত।

আসলে জেদ-ই মানুষকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেয়। শৈশবের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র না পাওয়া, বেদনাবোধই হয়তো যৌবনে তাকে কবির কাতারে ঠাঁই করে দিয়েছে। দগ্ধতা, আক্ষেপ, সর্বোপরি হতাশা কবি মজিদ মাহমুদের জন্য কবিতার মধ্য দিয়ে কল্যাণ বয়ে এনেছে। তবে এ কথা ঠিক, প্রতিভা শব্দটিকে আমরা আজও অলৌকিক অভিধায় ব্যাখ্যা করতে পছন্দ করি। আমি মনে করি, প্রতিভা কখনো অলৌকিক নয়। বলা যেতে পারে, সাধনার অপর পাঠ-ই হলো প্রতিভা; যা অসাধ্যকে সিদ্ধ করে। কবিতার মতো বেগবান এক স্বপ্নকে কাছে টেনে নেওয়ার জন্য শুধু ঝোঁক নয়, আমি বলব সত্যিকারের কাব্যপ্রতিভাটাও থাকা জরুরি। সম্প্রতী গার্হস্থ্য জীবন তাকে কবিতার মূল স্রোত থেকে টেনে নিয়ে গেছে অন্য স্রোতের দিকে। যেখানে যশ আছে, অর্থ আছে, আবার এটাও হতে পারে গদ্যে মনোযোগ দিতে গিয়ে মনে হয় শেষের দিকের কবিতাগুলো অনেকটা হাল ভাঙা পাল ছেঁড়া নৌকার মতো। চলে, তবে দিশাহীন।

এটা অনিবার্য যে, প্রথমেই একটি কবিতাকে ‘কবিতা’ হয়ে উঠতে হবে। এবং এই হয়ে ওঠাটাই কবিতার জন্য প্রথম ও প্রধান সমস্যা। এই সমস্যাকে কাটিয়ে একটি কবিতা যখন যথার্থই ‘কবিতা’ হয়ে ওঠে, প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই শুরু সম্ভাব্যতা; এই সম্ভব্যতার ব্যাপ্তি কতদূর প্রসারিত হবে সেটাও নির্ভর করে কবিতাটির ‘কবিতা’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার ওপরে; অর্থাৎ কীভাবে সে ‘কবিতা’ হয়েছে। মূলত এজন্য কবির সততা, নিষ্ঠা এবং প্রেম—এই তিন উপকরণই নির্দেশ করবে তার কবিতার সম্ভাব্যতাকে।

নাগরিক জীবন অন্তর্গত অস্থিরতায় যখন সন্নিকট, গৃহ ও প্রণয় দ্বিধাবিভক্ত তখন মজিদ মাহমুদের কাব্য চমৎকার উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে জ্বলজ্বল করে তার সূর্যের চেয়েও তীব্রতর সমন্বিত চোখ। তার মর্মবেদনার উৎসমুখ থেকে উৎসারিত হয় সমকাল নাম্মী সকালের অসংখ্য আঁধার-ছেঁড়া সোনালি আলোক কণিকা, কখনো দ্বন্দ্ব ও নিয়তির কাছে তার অভিমান, নিরাশার মাঝে স্বপ্ন দুলুনি মোহাবিষ্ট ও কিঞ্চিত ব্যথিত করে। আশায় আশায় মেঘের আশ্বাসের মতো মরুতৃষ্ণা বুকে বয়ে বেড়ানো কবির আকাঙ্ক্ষা একটি চমৎকার জীবনের। তার কবিতায় ঘুরেফিরেই বারাবার তিনি তা ব্যক্ত করতে চেয়েছেন।

জন্মভিটা পাবনার চর গড়গড়িতে। পাকে-চক্রে স্থায়ী হয়েছেন ঢাকায়। শৈশব তাকে টানে। বেদনার গাঢ় নীল-রঙে রক্তাক্ত হয়েই তিনি লেখেন। সকল সৃষ্টির মূলেই থাকে বেদনা। আর এর থেকেই জন্ম নেয়া ন্যারেটিভ-ধাঁচের তার কবিতাগুলো সহজ-সরল। নির্মেদ, কাহিনিনির্ভর। জ্ঞানগর্ভ। কবিতায় তার পরিমিতিবোধ এক বাক্যে দারুণ। চোখ খুলে চলতে চলতে তিনি নিমিষেই অন্ধ হয়ে যান। বাকিটা পথ চলেন পাঠকের চোখ দিয়ে। কবিত্বের খণ্ড নিয়ে তিনি তার ভাবনায় এঁকেছেন অপর কবিতা।

কবিতায় সামাজিক দায়িত্ব পালন করা যায়—এই আস্থাবোধে বিশ্বাসী কবি মজিদ মাহমুদ। যেহেতু তার ইতিহাস চেতনা অতীতমুখী নয়, ভবিষ্যৎমুখী, তাই চেতনা বারবার একটি কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত হয়েছে। কবিতাকে তিনি নিয়ে গেছেন জনসমাজের সাহিত্য থেকে দেশজ সংস্কৃতির আঙিনায়। কবিদের চোখে পৃথিবীটা চিরকালই দুঃখ ভারাক্রান্ত। আসলে একজন কবির জীবনোপলব্ধি কেমন হওয়া উচিত? জীবনের অর্থ খুঁজতেই তিনি কবিতা রচনা করেন। মজিদ মাহমুদ তার কল্পনা-মনীষা ও পাঠকের কল্পনা-মনীষার মেলবন্ধন কতটা ঘটাতে পেরেছেন সে কাল বিচার করবে। তিনি তার জীবনের পুরো বাস্তবতাকে না আনলেও কবিতার মধ্যে কবির জীবন দর্শন খুঁজে পাওয়া খুব একটা দুষ্কর নয়। তার আহরিত জ্ঞান, অভিজ্ঞ, যুগচেতনা, ভাবপ্রতিমা, প্রজ্ঞা—সবমিলিয়ে কবিতা হয়ে উঠেছে অনুভবপ্রতিমতুল্য। অবারিত অবক্ষয়, সামাজিক টানাপোড়েন আর আত্মধ্বংসের কনফেশন যা মজিদের কবিতার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। নীতি ও নীতিহীনতার মাঝখানের অংশটিতে যে আলো-আঁধারি তাকে মজিদ মাহমুদ মানতে চাননি কখনোই। কবিতায় তিনি যেন ফতোয়া জারি করেছেন। সমস্ত অন্যায় ও আপসের বিরুদ্ধে। কখনো কোনো কবিতায় এ রকম একরৈখিক বাচন উঠে আসতে দেখি আমরা। কবি কি কেবলি হতাশাগ্রস্ত? কেবলি নৈরাশ্যতাড়িত? মনে হয় না। কবির হৃদয়ে তাই দেশের মানুষের মুখ, গোটা পৃথিবীর মানুষের মুখ হয়ে যায়। অত্যন্ত সংযমী শব্দ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে মজিদ মাহমুদ। শব্দকে যখন তিনি কবিতায় গেঁথে দেন, তখন তার সবটুকু উপযোগিতাকে নিরীক্ষা করে নিতে ভুল করেন না। তার বর্ণাঢ্য শব্দরাশির নরম আতপ্ত অনুভূতি থেকে মানবিক স্বচিহ্নিত অগ্নি উৎস মূলত তার জীবন বোধের সুগভীর সান্নিধি যা বিস্ময়ে, অভিমানে, অভিসারে, ক্রোধে, অহংকারে শুরু থেকে শেষাবধি কাঁটাছেঁড়া পৃথিবীর পৃষ্ঠকে আঁকড়ে ধরে উত্তাপিত উদ্ভাসিত ফুলেল অধিকারে আনেন।

তার কবিতার চারুমুখ দর্শন করতে করতে এমন একটা সিদ্ধান্তে এসে দাঁড়াই এবং বলতে পারি, মজিদ মাহমুদ এখানেই কালো রোমান্টিক কিংবা ধূসর আধুনিক। কেননা ডেকাডেন্ট সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেও চেতনায় জেগে থাকে তার পবিত্রতার স্বপ্ন।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়