ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৫ ১৪৩০

কলকাতার যেসব স্থানে ঢুঁ মারতে ভুলবেন না

মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার

প্রকাশিত: ১৩:২৯, ২৫ মার্চ ২০২৩  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

কলকাতা নামটি শুনলেই শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ নগরীর দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কলকাতা সর্ববৃহৎ শহর ও প্রধান বন্দর হিসেবে বিরাজমান। এ মহানগরী ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল।

পরে এটি অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের রাজধানী হয়। লন্ডনের পরই দ্বিতীয় স্থানে অবস্থিত এটিকে ‘সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগর’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এর নিজস্ব মার্জিত ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের জন্য কলকাতাকে ‘প্রাসাদ নগরী’ও বলা হতো।

বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ১৩৮ কিলোমিটার উত্তর দিকে হুগলি (ভাগীরথী) নদীর বাম (পূর্ব) তীরে অবস্থিত। এটি অন্য তিন দিক থেকে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা দ্বারা বেষ্টিত।

‘কলকাতা’ চার বর্ণের নামটি মনে এলেই ভেসে ওঠে টানা রিকশা, ট্রামের শব্দ কিংবা হলদে ট্যাক্সি। দীর্ঘদিনের পথচলায় শহরটি যেন হয়ে উঠেছে একটি বিশেষ ঐতিহ্যের ধারক।

বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এ কলকাতা যেন শুধু একটি শহরই নয়, একটি জীবনধারা, একটি আবেগ। আমার বাড়ি খুলনা থেকে কলকাতার দূরত্ব খুব বেশি নয়। এ অঞ্চলের মানুষের একসময় নিত্য যাতায়াত ছিল কলকাতায়।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মামা বাড়ি ও তার শ্বশুরবাড়ি খুলনা হওয়ায় সহজে অনুমেয় খুলনা অঞ্চলের সঙ্গে কলকাতার যোগসূত্র অনেক গভীর। সীমানার কাঁটাতার দু’বাংলার মেলবন্ধনে ছেদ টানলেও জীবিত আছে দু’বাংলার মানুষের আবেগ ও অনুভূতি।

আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল ঐতিহ্যের নগরী ঘুরতে যাওয়ার। সে ইচ্ছার পালে নতুন হাওয়া যুক্ত করলেন আমার বাবা। তিনিও আমার সফরসঙ্গী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করায় অবশেষে মার্চের প্রথম সপ্তাহে রওনা হলাম একসময়ের রাজধানী ও আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ কলকাতা শহরের দিকে।

খুলনা থেকে সড়ক ও রেলপথে কলকাতা যেতে হলে প্রথমে বেনাপোল স্থলবন্দর যেতে হবে। ঘণ্টা দুয়েকের যাত্রা শেষে বেনাপোল স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন শেষ করে ভারতের মাটিতে পা রাখার প্রক্রিয়া একদম সহজ নয়। এ প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট সময় ও ধৈর্য ধরতে হবে।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়ভাই বেনাপোল বন্দর থানার সাব-ইন্সপেক্টর সোহেল রানা ভাইয়ের আতিথেয়তা গ্রহণ করে আমরা ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষে প্রবেশ করলাম ভারতের মাটিতে। সীমান্তের বাংলাদেশ অংশের নাম বেনাপোল ও ভারত অংশের নাম পেট্রাপোল।

পেট্রাপোল থেকে বনগাঁও স্টেশনের উদ্দেশ্যে অটোতে চড়লাম। বনগাঁও স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে শিয়ালদহ স্টেশন হয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার অনুভূতি নিশ্চয়ই আনন্দের। নতুনকে জানার ও দেখার আনন্দ নিশ্চয়ই ভ্রমণপিপাসু বাবা-ছেলেকে পুলকিত করলো।

প্রায় তিন ঘণ্টার যাত্রা শেষে শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে স্টেশনের কাছেই থাকার জন্য হোটেল পেয়ে গেলাম। যদিও অনেকে শিয়ালদহ থেকে অটোতে চেপে কলকাতা নিউমার্কেট এলাকার মারকুইস স্ট্রিটে থাকার জন্য চলে যেতে পারেন।

বাংলাদেশিদের থাকার জন্য পর্যাপ্ত হোটেল আছে। ৮০০-২০০০ রুপির মধ্যে বিভিন্ন সুবিধার রুম নেওয়া যায়। মানি এক্সচেঞ্জও করতে পারবেন সেখানে। কলকাতা দর্শন শুরু হলো হাওড়া স্টেশন দিয়ে। শিয়ালদহ স্টেশন এলাকা থেকে বাস বা অটোতে করে যাওয়া যাবে খুব কম সময়ে।

হাওড়া জংশন রেলওয়ে স্টেশন ভারতের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে কমপ্লেক্স আর বড় স্টেশনের মুকুট তার মাথায়। ১৬৪ বছরের পুরোনো স্টেশনটির প্ল্যাটফর্ম সংখ্যা ২৩ ও ট্র্যাক ২৬টি। এটি দেখে আমরা হেঁটে পার হলাম বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজ, ১৯৪৫ সালে নির্মিত এই কান্ট্রিলিভার ব্রিজটি সম্পূর্ণ লোহার তৈরি।

ব্রিজ দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে যাই অপর পার মল্লিক ঘাটে। এখানকার বিখ্যাত ফুলের বাজার দেখে আমরা চড়লাম শিয়ালদহের বাসে।

ধর্মতলা হয়ে কলকাতা নিউমার্কেট ঘুরে কলকাতার যাদবপুরের নাট্যসংগঠন দলমাদলের সভাপতি সঞ্জয় দাদার আতিথেয়তায় কলকাতায় আকাশবাণী বেতারের অফিস ও প্রাচীনতম স্টেডিয়াম ইডেন গার্ডেন্স হয়ে গড়ের মাঠ।

এর মধ্যে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ দেখার ইচ্ছা থাকলেও তা পূরণ হয়নি, সেটি সামরিক স্থাপনা হওয়ায়। গড়ের মাঠ আমার কাছে খুবই পরিচিতি নাম। এখানে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে গড়ের মাঠের মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে রওনা হলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পথে।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল প্রাচীন কলকাতায় অবগাহন করে ব্রিটিশদের নিজস্ব স্থাপত্যশৈলী আর রানির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন। এটি একটি মিউজিয়াম, যেখানে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।

শিল্প-সাহিত্যের চর্চার স্থান রবীন্দ্র সদন, নন্দন ও ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিল্ম আর্কাইভ ঘুরে মেট্রোরেলে চড়ে রওনা হলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে। মেট্রো থেকে নেমে অটোতে করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুটা সময় কাটালাম।

দলমাদলের আয়োজনে বঙ্গবন্ধু নাট্য উৎসবের সম্মাননা স্মারকও সেখানে তুলে দিলেন সঞ্জয় দাদা। এরপর যাদবপুর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে চলে এলাম শিয়ালদহ।

কলকাতার ফুটপাত ঢাকা শহরের তুলনায় গোছানো। ট্রাম, ট্টেন ও মেট্রোরেলে জনগণ যাতায়াত করে বেশি। এটি অনেক বেশি সাশ্রয়ী ও সময় বাঁচায়। যেটি আমার কাছে মনে হলো নাগরিক জীবনের গতি আনার উপাদান।

কলকাতা অনেক বড় শহর। হাতে সময় নিয়ে এলে ঘোরার জন্য আছে অনেক জায়গা। পুরোনো কলকাতার গন্ধ নিয়ে মাটির ভাড়ে চা পান করতে করতে ঢুঁ মারা যেতে পারে কলেজ স্ট্রিটে। এশিয়ার সবচেয়ে বড় বইয়ের বাজার এটি।

সঙ্গে আছে সংস্কৃত কলেজ, কলকাতা মেডিকেল, প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো নামি সব প্রতিষ্ঠান। সন্ধ্যাটা কাটাতে পারেন মান্নাদের কফি হাউজে মোঘলাই পরোটায় কামড় আর কফির ইনফিউশনে চুমুক দিয়ে। সঙ্গে হতে পারে সেই গান ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’!

ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে একটু আধুনিকতা আর বিদ্যা মেশাতে চাইলে যেতে হবে সায়েন্স সিটি, নিক্কোপার্ক, নিউটাউন, ইকোপার্ক, সিটি সেন্টারে। তিলোত্তমা কলকাতার মজাটা হলো আপনি একে যে রূপে চাইবেন, শহর আপনাকে সে রূপেই ধরা দেবে।

মাতৃরূপে, প্রেয়সী বা বন্ধু সব ক্ষেত্রেই পাবেন সমভাবে। রাস্তায় একা হাঁটুন বা বন্ধুর সঙ্গে অথবা প্রেয়সীর হাত ধরে কিংবা আমার মতো বাবার হাত ধরে, এতটুকু নিশ্চয়তা দেওয়াই যায়; কলকাতা আপনাকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করবে না।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়