ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৫ ১৪৩০

দেখে আসুন কক্সবাজারের গায়েবী মসজিদ

এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন

প্রকাশিত: ১৪:৩২, ১ জানুয়ারি ২০২৩  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

মুসলিম স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন কক্সবাজারের গায়েবী বা আজগবি মসজিদ। এই মসজিদে আসেন, হিন্দু, বৌদ্ধসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক। মসজিদটি কে, কখন, কীভাবে নির্মাণ করেছেন এ সংক্রান্ত কোন তথ্য কারো কাছে নেই।  প্রতিদিন এ মসজিদে আসেন অসংখ্য পর্যটক। কেউ কেউ আসেন মনের আশা পূর্ণ  করতে মানত করেন।

মসজিদটি আয়তনে খুব ছোট। এর উত্তর পাশে রয়েছে একটি বিশাল দিঘি। মসজিদটির ভেতরে উত্তর-দক্ষিণ লম্বা ২৩ফুট, পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা ১৪ ফুট। মসজিদের বাইরে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ৩৪ ফুট আর পূর্ব-পশ্চিমে ২৬ফুট। মসজিদের সামনে তথা পূর্ব দিকে পাঁচ ফুট বা ছয় ফুটের একটি বারান্দা ছিল। তার সামনে ছিল খোলা সাহান বা উঠান।

মসজিদের মূল পিলার বা স্তম্ভ চারটি। মসজিদের একটি মাত্র দরজা। দরজার উচ্চতা পাঁচ ফুট। জানালা রয়েছে দুটি। জানালার উচ্চতা সাড়ে চার ফুট, প্রস্থ তিন ফুটের মতো। বর্তমানে মসজিদের ফ্লোরটি পাঁচ থেকে ছয় ফুট ভরাট হয়ে গেছে। মসজিদের ছাদের উপর রয়েছে পাশাপাশি তিনটি গম্বুজ। মসজিদের ফ্লোরে বসানো হয়েছে টাইলস। ফলে কত নিচে মূল ফ্লোর রয়েছে তা বলা মুশকিল। ঐতিহাসিক  মসজিদের চিত্র এটি।

কক্সবাজার শহরের বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন সড়কের পূর্ব  পার্শে এর অবস্থান। ভেতরে প্রাচীন এই মসজিদের অবস্থান। কক্সবাজার বাস টার্মিনালের উত্তরে পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ড বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় ধান ক্ষেতের মাঝখানে গম্বুজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। তবে মসজিদটি অনেকের কাছে বিভিন্ন নামে পরিচিত। অনেকেই বলে সাচী মসজিদ। আবার অনেকেই মোঘল আমলের মসজিদ, গায়েবী মসজিদ ও পোটকা মসজিদ নামেও পরিচিত। কিন্তু মসজিদ আসলেই কোন আমলে বা কে তৈরি করেছিল তার সঠিক তথ্য কেউ জানে না। এমনকি কত বছর আগের মসজিদ তাও সঠিক তথ্য নেই। বর্তমানে এটি সাচী চৌধুরী মসজিদ হিসেবে নাম রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগের তথ্য সেবায় বলা হচ্ছে, ১৬০০-১৭০০ খৃষ্টাব্দে শাহসুজার আমলে একটি মসজিদ তৈরি হয়েছিল। এটি চৌধুরী পাড়া মসজিদ বা আজগবি মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদ কমিটির সভাপতি মাস্টার গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আসলে মসজিদ কে তৈরি করেছিল এর সঠিক তথ্য বা ইতিহাস কেউ জানে না। এমনকি কত বছর আগে তাও জানা নেই। অনেকেই বলে এই মসজিদের বয়স সর্বনিম্ন ৪০০ বছর অথবা সর্বোচ্চ ৬০০ বছর । বেশির ভাগ ৪০০ বছর উল্লেখ করা হয়। তবে সঠিক পরিসংখ্যান  কেউ জানে না। তাই অনেকে বলে এই মসজিদ জ্বীনেরা তৈরি করে গেছেন বহুকাল আগে।মানুষ শুধু মাঝেমধ্যে সংস্কার করেছেন। 

কক্সবাজারের ইতিহাস নামের একটি বইয়ের তথ্য অনুসারে- সাচী চৌধুরী মসজিদটির নির্মাণ শৈলী মোগল আমলের আদলে হলেও মসজিদটি মোগল আমলে নির্মিত হয়নি। সাচী চৌধুরীর আদি নিবাস চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায়। তিনি কি ভাবে কখন কি উদ্দেশ্য কক্সবাজার এসেছিন তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে জনশ্রুতি রয়েছে বহুকাল আগে জীনেরা এ মসজিদ তৈরি করেছিল।এখন রাতের বেলায় মসজিদে জীনেরা নামাজ আদায় করেন নিয়মিত।

মসজিদ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে নানা রকম মন্তব্য রয়েছে। মসজিদ কমিটির লোকজন বলেন, ‘মূল মসজিদের পূর্বে সেখানে বারান্দা ছিল বর্তমানে সেখানে নতুন করে মসজিদ বাড়ানো হয়েছে। প্রায় সাত কাতার মতো বারান্দার জায়গাটি এখন দ্বিতল করা হয়েছে নামাজের জন্য। এছাড়া মসজিদের উত্তরপাশে রয়েছে ফ্লোর করা খোলা জায়গা। যেখানে প্রায় ১০০ জন মতো নামাজ আদায় করতে পারে।’

মসজিদের দক্ষিণ পূর্ব পার্শের বিরাট এলাকা জুড়ে কবরস্থান। উত্তরে বিশাল দীঘি।সব মিলিয়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিক দৃশ্যতায় পরিবেশে দেশ বিদেশের মুসলৃলিরা এখানে নামাজ আদায় করেন আর প্রশান্তি লাভ করেন।মসজিদের নির্মাণশৈলী ও স্থাপত্য সৌন্দর্য সবার নজর কাড়ে। মসজিদের দেয়াল প্রায় প্রায় পাঁচ ফুট চওড়া। কোথায়ও লোহার ব্যবহার হয়নি। চুন- সুরকি দিয়ে তৈরি মসজিদের দেয়াল ও গম্বুজ। মসজিদটির ওপর রয়েছে একটি বিশালাকার গম্বুজ। ১৫ টি গম্বুজ দিয়ে তৈরি হয় এ মসজিদটি।

এছাড়া মসজিদটি ঘিরে রয়েছে নানা কিংবদন্তি। স্থানীয় মুসল্লি নুরুল হুদা বলেন, ‘আমার পিতা মৌলানা আবুল হোছাইন অনেক বছর এ মসজিদে ইমামতি করেছেন। তার পিতার মুখ থেকে শোনা কথা, জ্বীনেরা এ মসজিদে বেশি সময় ধরে এবাদত বন্দেগি করতেন। তাই মুসল্লীরা গভীর রাত পর্যন্ত অবস্থান করতেন না। অনেক সময় মাগরিব ও ইশা নামাজ একসঙ্গে পড়তে হতো।’ 

নুরুল হুদা আরো বলেন, ‘ফজরের আজান দেয়ার জন্য তার পিতা মসজিদের আশেপাশে অবস্থান করতেন কখন সুবেহ ছাদেক হবে। জীনেরা চলে গেলে তারপর আজান দিতেন। এমনকি সারারাত সেখানে জ্বীনেরা সমস্বরে কোরাআন তেলোওয়াত করতেন। শব্দ শোনা যেত বাইর থেকে। অনেক অলৌকিক ঘটনা রয়েছে মসজিদটিতে। কিছুদিন আগে বিজিবির এক সদস্য আলো জ্বালিয়ে এশার নামাজ আদায় করেছেন এমন সময় অলৌকিক ভাবে আলো নিভে গেলে আবার আলো জ্বালানোর চেষ্টা করলে অচেতন হয়ে পড়ে যায়। পরের দিন সকালে মুসল্লিরা তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে। 

বর্তমান এ মসজিদের খতিব আমান উল্লাহ বলেন, ‘এক সময় দিনের বেলাতে ভয় পেত মুসল্লীরা। অন্য ধর্মের লোকজন ও প্রতিদিন মানত দিতে এই অলৌকিকে মসজিদে আসেন।আসেন অসংখ্য পর্যটক ও। ১৯৬০ সালে ও ১৯৯১ সালের প্রলংকরী ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে ও মসজিদ টি অক্ষত। অথচ আশেপাশের অনেক মজবুত স্থাপনা ও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ মসজিদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি প্রাকৃতিক ভাবে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত। গরমের সময় ঠান্ডা আর শীতকালে গরম অনুভূত হয়।’

কক্সবাজার শহরের যেকোন প্রান্ত থেকে অটো বা টমটম যোগে মাত্র ১০ টাকা দিলেই নামিয়ে দেবে বিজিবি ক্যাম্প এলাকায়। সেখান থেকে মাত্র দুই তিন মিনিটে পায়ে হেটে পৌঁছে যেতে পারেন চৌধুরী পাড়ার এই মসজিদে। প্রধান সড়ক থেকে বাদিকে থাকালেই দেখতে পাবেন প্রাচীন এই মসজিদটি।এটিকে কক্সবাজারের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ ও বলা হয়। অনেকে বলে থাকেন জ্বীনের তৈরি মসজিদ।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়