ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ভরদুপুরের ভূত

খান মুহাম্মদ রুমেল

প্রকাশিত: ১৪:২৬, ৭ মে ২০২৩  

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

ভরদুপুরে রাবিদ যখন হাঁটতে বের হয়; আকাশে তখন তাতানো সূর্য! সূর্যের প্রখর তাপ বলেই হোক অথবা এটি পুরোদস্তুর অফিস সময় বলেই হোক—রাস্তা-ঘাট প্রায় ফাঁকা। রাবিদ হাঁটা শুরু করেছিল বাংলা মোটর থেকে শাহবাগ সড়ক ধরে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় সে নিজেকে আবিষ্কার করে পরিবাগ সড়কে। এই সড়কটা বরাবরই খুব প্রিয় তার। ছায়াঢাকা পথটুকুতে সব সময়ই একটা শান্ত নিঝুম ভাব বিরাজ করে। প্রচণ্ড শহুরে গতি এখানে এসে যেন থমকে গেছে। দুপুর রোদে ক্লান্ত রিকশাচালকরা এই সড়কের কোনো একটা গাছের নিচে রিকশা রেখে সিটটা খুলে পাদানিতে রেখে তার ওপর শুয়ে আরামসে ঘুম দেয়। চা দোকানিরাও কাস্টমারের ব্যস্ততার মধ্যেও কেমন যেন অলস ভাব ধরে চা বানায়, বিড়ি-সিগারেট এগিয়ে দেয়। শেষ বিকেলের দিকে পথশিশুদের নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে স্কুল বসায় কয়েক তরুণ-তরুণী। শিশুরা যতটা না পড়ে; তারচেয়ে বেশি খেলে। এসবের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। গাড়ি, রিকশা, বাইসাইকেলের গতি কমে যায়, কখনো কখনো তীব্র জ্যাম লেগে যায়—তবু কেউ বিরক্ত হয় না। এক এক চিলতে সড়ক যেন শহরের মধ্যে আলাদা এক জগৎ।

আজ দুপুরে এই সড়কে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখা সোহেলের সঙ্গে। সোহেল তার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু। এক সময় অনেক ঘনিষ্ঠতা ছিল। নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। প্রায় প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে পথের ধারের কোনো চায়ের দোকানে, না হয় সস্তার কোনো রেস্টুরেন্টে বসে ঘণ্টার পর আড্ডা দিতো তারা। তারপর লোকাল বাসে চড়ে একসঙ্গে বাড়ি ফিরতো দুজন। সোহেল তখন থাকতো শনির আখড়ার দিকে কোনো একটা জায়গায়। আর রাবিদ থাকতো যাত্রাবাড়ির কাছে ধলপুরে। দুজনের অফিস ছিল তেজগাঁও শিল্প এলাকায়—নাবিস্কো মোড়ের কাছে। দুজন দুই অফিসে কাজ করতো। আজ অনেক বছর পর সোহেলের সঙ্গে দেখা হলে দুজনেই বুঝতে পারে—অনেক দিনের অদেখায় দুজনের যোগাযোগ কমেছে ঠিকই, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা কমেনি একটুও। রাবিদ আর সোহেল—দুই বন্ধু গিয়ে বসে পরিবাগ সড়কের অলস চাওয়ালাদের বেশকিছু দোকানের একটিতে। তারা দুজন যখন রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতের দোকানে ঢোকে; আকাশে তখন কমে গেছে রোদের তেজ। ভাদ্রের আকাশ হঠাৎ করেই ভরে গেছে শ্রাবণের জল থইথই কালো মেঘে। দুজনের কারোই তা নজরে পড়ে না। দুই বন্ধু মেতে ওঠে প্রাচীন আড্ডায়। হাজার বছরের জমানো কথা দুজন মিলে বলে ফেলতে চায় এক পলকে। কথার খই ফুটতে থাকে তাদের মুখে-চোখে এবং হাত-পা-মাথার নানা ভঙ্গিতে।

দুই বন্ধুকে চায়ের দোকানে রেখে আমরা ফিরে যেতে চাই বারো বছর আগের আরেক রোদজ্বলা দুপুরে অথবা শীতার্ত সন্ধ্যায়। রাবিদ তখন ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া বোহেমিয়ান তরুণ। খণ্ডকালীন কাজ করে এক খবরের কাগজে। ফিচার-টিচার লিখে হাতখরচের টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করে। আর সোহেলের কাঁধে তখন পুরো পরিবার। এসএসসির পর আর পড়াশোনা করা হয়নি তার। তখন থেকেই তাকে নামতে হয়েছিল জীবন বাঁচানোর, পরিবার বাঁচানোর যুদ্ধে। এসএসসি পাসের পর ১৬ বছরের কিশোর সোহেল নীলক্ষেতে কম্পিউটারের দোকানে টাইপিস্টের কাজ করেছে। সোহেল কখনো বলেনি, তবে আমরা জানি তাকে শারীরিক শ্রমের কাজও করতে হয়েছে—একটি পরিবারকে খাইয়ে পরে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে। তবে সোহেল অসম্ভব মেধাবী এক যুবক। সার্টিফিকেটের জোর না থাকলেও জ্ঞানের জোর ছিল তার। তার প্রিয় বিষয় দর্শন। রাবিদরা যখন বাজার চলতি সাহিত্য পড়ে দিন কাটায়; সোহেল তখন পৃথিবার বিখ্যাত সব ফিলোসফারের লেখা পড়ে, নিজের মধ্যে ধারণ করে, নিজেও সেভাবে লেখার চেষ্টা করে। আর এই করতে করতে সোহেল এক সময় খবরের কাগজের রিপোর্টার হয়ে ওঠে। সাংবাদিকতার সুবাদে সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। আর ব্যাপক পড়াশোনার সুবাদে বুদ্ধিজীবী মহলের সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় তার। সব মিলিয়ে রাবিদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের কেউ কেউ সোহেলকে ভেতরে ভেতরে ঈর্ষা করতে শুরু করে। সেই ঈর্ষা থেকে এক ধরনের তাচ্ছিল্য দেখায় সোহেলের প্রতি। তাচ্ছিল্য থেকে তাকে খারিজ করে দেওয়ার চেষ্টা, তার মেধাকে অস্বীকারের চেষ্টা এবং সবশেষে যেটা করি আমরা—পেছন থেকে টেনে ধরা, ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া—কোনোটাই বাদ দেয়নি শিক্ষিত সমাজ।

তবে সব বাঁধা উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছে সোহেল। নিজের অবস্থান তৈরির চেষ্টা করেছে। তাকে ঘিরে এ ধরনের একটা অপচেষ্টার বিষয়টা সোহেলও বোঝে। বুঝেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীরব থাকার চেষ্টা করে সে। আবার কখনো কখনো ক্ষেপে যায় চরমভাবে। তখন আচ্ছামতো গালাগাল করে সবাইকে। একেবারে কাঁচা বাংলায়। সেই সোহেল একদিন হঠাৎ করেই চাকরিটা ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দেয় মানে সম্পাদকের সঙ্গে কী একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে তার রুমে গিয়েছিল সোহেল। মিনিট বিশেক পর রুম থেকে বের হয়েই সোজা নিজের ডেস্কে এসে খসখস করে কিছু লিখছিল সে। অল্প সময় পরেই সহকর্মীরা বুঝতে পারলো এটা ছিল সোহেলের রিজাইন লেটার। হাতে লেখা চিঠিটা সম্পাদকের টেবিলে রেখে তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই গটগট করে বের হয়ে এসেছিল সোহেল। সেই বের হয়ে যাওয়াই ছিল তার শেষ যাওয়া। এরপর সম্পাদক সাহেব একে তাকে দিয়ে নানাভাবে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু সোহেলকে আর ফেরানো সম্ভব হয়নি।

এদিকে ঝোঁকের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে অথৈ সাগরে পড়ে সোহেল। ঢাকা শহরে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই তার ছিলই। তবে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেই লড়াইয়ে সোহেল তখন ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার। তবে কর্মঠ মেধাবী সোহেল বসে থাকার ছেলে নয়। কাজের খোঁজে নানা জায়গায় ঘুরতে থাকলো। ঘুরতেই থাকলো। একপর্যায়ে কীভাবে কীভাবে যেন সিনেমার দলে ঢুকে গেলো। সরকারি অনুদানে সিনেমা বানাচ্ছেন এক নামি পরিচালক। সেই টিমে সোহেল হয়ে গেলো পরিচালকের সহকারী। সিনেমার টিমের সঙ্গে দেশের নানা জায়গায় ঘুরতে থাকলো সে। তবে কাজের ফাঁকে ঢাকায় এলেই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মাতে সোহেল। চাকরি ছাড়ার পর কিছুদিনের জন্য মিইয়ে যাওয়া সোহেল আবার পুরোনো উচ্ছ্বাসে, উল্লাসে, জীবনের জয়গানে ফিরে আসে। অফিস শেষের সন্ধ্যায় রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে আড্ডায় সিনেমার গল্প বলে বন্ধুদের মাতিয়ে তোলে সোহেল।

তাদের সিনেমার সেট পড়েছে ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জের এক গ্রামে। ইছামতি নদীর ধারে বিশাল এক বটগাছের তলায় শুটিং। শুটিংয়ের আগের দিন বিকেলে সেখানে রেকি করতে গেছে সোহেলসহ ইউনিটের কয়েকজন। এ সময় গ্রামের লোকজন জিজ্ঞেস করে, আপনাদের সিনেমার নায়িকা কে? চিরকালের রসিক সোহেল বলে, শাবনূর। এলাকার লোকজন আর কিছু বলে না। পরের সকালে শুটিং করতে গিয়ে তাজ্জব অবস্থার মধ্যে পড়ে তারা। এলাকা লোকে লোকারণ্য। চারপাশে নানা বয়সের হাজার খানেক মানুষ। সবাই শাবনূরকে দেখতে চায়! শাবনূরকে না দেখালে এখানে কোনো শুটিং করতে দেওয়া হবে না—তাদের সাফ কথা! বিষয়টাকে প্রথমে খুব একটা পাত্তা দেন না পরিচালক আসলাম ভাই। গ্রামের দিকে শুটিং করতে গেলে এমন অনেক সমস্যায় পড়তেই হয়। আসলাম ভাই তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় জানেন, এগুলো সহজেই ম্যানেজ হয়ে যায়। গ্রামের মানুষ একটু গাঁইগুঁই করে। তারপর যে যার কাজে চলে যায়। আর কিছু মানুষ শুটিং ইউনিটের সঙ্গে আঁঠার মতো লেগে থাকে সব সময়। এদের দিয়ে ইউনিটের নানা কাজ মুফতে করিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু এদিনের ঘটনা তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্রমেই মানুষের শোরগোল বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে সেটি এক সময় উত্তেজনায় রূপ নেয়। কোনোভাবেই মানুষকে শান্ত করা যায় না।

একপর্যায়ে পরিচালক হ্যান্ডমাইক হাতে নিয়ে ঘোষণা দেন, প্রিয় গ্রামবাসী, আমাদের সঙ্গে নায়িকা শাবনূর নেই। তবে আমাদের সঙ্গে আছেন নবাগত নায়িকা গুঞ্জন খান। আপনারা চাইলে তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন। শুটিং শেষে আপনাদের তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দেওয়া হবে। সোহেল অভিনয় করে দেখায় বন্ধুদের, আসলাম ভাই কেমন রাজনৈতিক নেতার মতো হাত-পা ছুঁড়ে বক্তৃতা করেছিলেন।
এরপর কি হলো?
কৌতূহল ধরে রাখতে পারে না কাদের। অন্যরাও জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে পরের ঘটনা জানার জন্য।

এরপর শুটিং ইউনিট লক্ষ্য করে শুরু হলো বৃষ্টির মতো ঢিল! আসলাম ভাইয়ের বক্তৃতা শেষ হতেই সমবেত মানুষের মাঝে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠেছিল। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢিল পড়তে থাকলে ইউনিটের সবাই দৌড়ে আশ্রয় নিয়েছিল পাশের স্কুলঘরে। স্কুলের টিনের চালায়ও পড়ছিল একের পর এক ঢিল। তাদের একটাই কথা, শাবনূরকে না দেখে কেউ যাবেন না। এভাবে আটক থাকতে হয়েছিল প্রায় ঘণ্টাখানেক। মানুষের ভিড় একপর্যায়ে কমে। তবে শুটিং ক্যানসেল হয়ে যায় সেদিনের মতো। ক্যাম্পে ফিরে আসলাম ভাই খুব শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, শাবনূর আসবে এই কথা ছড়িয়েছিল কে? নিশ্চয়ই আমাদের কারো কাজ এটা! পিনপতন নীরবতায় এগিয়ে এসেছিল সোহেল। সেদিনই ইউনিটে শেষ দিন ধরে নিয়ে মনে মনে চলে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সোহেল। আসলাম ভাই মিনিট তিনেক তাকিয়ে ছিলেন সোহেলের দিকে। তারপর কোটের পকেট থেকে দুটি টিকিট বের করে দিয়েছিলেন শেরাটন হোটেলের। একদিন একরাত শেরাটনে কাটানোর কাপল টিকিট। এখন সোহেল কাপল হওয়ার জন্য সঙ্গী পাবে কোথায়? সিনেমার সেট ডিজাইনার সোহরাব সঙ্গী হয় সোহেলের। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আসলাম ভাই শেরাটন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কমপ্লিমেন্টারি টিকিট দুটো পেয়েছিলেন। কিন্তু শুটিং ব্যস্ততার কারণে তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না। তাই সোহেলকে টিকিট দুটি দিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

সেদিনই মানিকগঞ্জ থেকে সোজা শেরাটনে চলে আসে সোহেল আর সোহরাব। হোটেলে ঢুকতে ঢুকতে দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ডিনার শেষে হোটেলের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে দুজনের নজরে পড়ে ডিজে পার্টির লবির দিকে। কিন্তু সেটার এন্ট্রি ফি দশ হাজার টাকা দেখে ব্যর্থ মনে ফিরে যাচ্ছিলো দুজন। এ সময় দেবদূতের মতো তাদের সামনে হাজির হয় হোটেলের এক স্টাফ। তিনি জানান, রুম হোল্ডারদের জন্য ডিজে ফ্রি। উল্কার গতিতে দুজন ঢুকে যায় লবিতে। আলো-আঁধারি কক্ষের একটা সোফায় দুজন বসে থাকে চুপচাপ। সোহেলের ভাষায়, পাঁচ মিনিট পর সে নিজেকে আবিষ্কার করে ডিজে স্টেজে। পাগলের মতো নাচছে সে। সারারাত হোটেলে কাটিয়ে দুজন যখন শেরাটন থেকে বের হয়—সোহেলের স্যান্ডেলের এক পাটি তখন ছেঁড়া। গত রাতের নাচানাচির ধকল সইতে না পেরে ছিঁড়ে গেছে স্যান্ডেলের ফিতা। নয় নম্বর বাসের হ্যান্ডেল ধরে দুজন যখন গাবতলীর দিকে যাচ্ছে; তখন দুজনের পকেটে মানিকগঞ্জ যাওয়ার বাস ভাড়া আছে কি না, সে নিয়ে বেজায় দুশ্চিন্তা তাদের!

সিনেমার শুটিং শেষ হয়ে গেলে সোহেলও বেকার হয়ে পড়ে। কাজের খোঁজে নানা জায়গায় ঘুরতে থাকে সোহেল। কিন্তু কিছুতেই কিছু কাজ হয় না। এই সময় হঠাৎ এক দুপুরে রাবিদের সঙ্গে সোহেলের দেখা হয়ে যায় ফার্মগেট মোড়ে। সোহেলের হাতে অনেকগুলো লিফলেট। ঘামে ভেজা মুখে একটা সস্তার তোয়ালে পেঁচানো রোদ থেকে বাঁচার জন্য। কথা বলে রাবিদ জানতে পারে, যৌন রোগের নিশ্চিত নিরাময়ের শতভাগ গ্যারন্টি দেওয়া এক কবিরাজি প্রতিষ্ঠানের লিফলেট এসব। বাসে বিলি করে সে। প্রতি লিফলেট বিতরণের জন্য এক টাকা করে পায় সোহেল। দিনে পাঁচ-ছয়শ লিফলেট বিরতণ করতে পারে।
কোনো কাজ পাস না, তাই বলে এসব করবি? অবাক চোখে জিজ্ঞেস করেছিলো রাবিদ।
খুব শান্ত নিরুত্তাপ গলায় সোহেল বলেছিল, চল দোস্ত চা খাই।
তবে লিফলেট বিতরণের কাজ সোহেল বেশেদিন করেনি কিংবা তাকে করতে হয়নি। রাবিদ একদিন শুনতে পায়, টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখছে সোহেল। শুনে বেশ ভালো লাগে তার। এমন একটা সৃষ্টিশীল কাজই তো সব সময় করতে চেয়েছিলো সোহেল। টেলিভিশন নাটক লিখলে কিছু টাকা আয় হবে, আবার নামও হবে। সব মিলিয়ে এটাই সোহেলের জন্য ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু একদিন রাবিদ জানতে পারে, নাটক সোহেল লেখে ঠিকই। তবে সেটি নিজের নামে প্রচার হয় না। টেলিভিশন নাটকের এক খ্যাতিমান অভিনেতার খায়েশ হয়েছে তিনি নাটক লিখবেন এবং প্রযোজনা করবেন। কিন্তু চাইলেই কি আর নাটক লেখা সম্ভব? সুতরাং হায়ার করলেন সোহেলকে। তারও টাকার প্রয়োজন। অগত্যা সোহেল নাটক লিখে দিতে থাকলো, আর সেই অভিনেতা নাট্যকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন! চারদিকে ধন্যি ধন্যি পড়ে গেলো। ঘটনা শুনে রাবিদ ঠিক করলো, এ নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট করে দেবে। সোহেলের সঙ্গে আলাপ করতেই নিষেধ করলো সে। সোহেলের কথা হলো তার দরকার টাকা-পয়সা। আর ওই অভিনেতার প্রয়োজন নাম-যশ-খ্যাতি। সুতরাং এটা নিয়ে যেন রাবিদ বাড়াবাড়ি না করে। বন্ধুর কথা মেনে নিয়ে বিষয়টা চেপে যায় রাবিদ।

এরপর সময় গড়িয়েছে দ্রুত। শখের বসে খবরের কাগজে কাজ করতে এসে সেটাই পেশা হয়ে গেছে রাবিদের। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করতে না করতেই রাবিদ আর নন্দিনী বিয়ে করে ফেলে। কারণ নন্দিনীর পরিবার বিয়ের জন্য খুব চাপ দিচ্ছিলো। রাবিদ তখন অল্প কটা টাকা বেতন পায়। সেই টাকায় তার নিজের একা চলাই মুশকিল। এক শ্রাবণের প্রবল বর্ষণমুখর দুপুরে নন্দিনীকে বিয়ে করে কাজি অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাবিদ ভাবে, এরপর কি! তার পকেটে তখন দেড় হাজারের মতো টাকা আর এক কামড়ার যে বাসাটাতে সে থাকে, সেই ঘরের আলমারির উপরের তাকে একটা প্লাস্টিকের কৌটায় জমানো আছে হাজার পাঁচেক টাকা। এই দিয়ে কীভাবে চলবে তাদের সংসার? এ সময় হঠাৎ রাবিদের পিঠে আলতো করে হাত রাখে নন্দিনী। স্পর্শে মনে হয় রাবিদের—সামনে যাই থাকুক, নন্দিনী এখন আমার বর্তমান। ভবিষ্যতকে সুন্দর করার জন্য বর্তমানে কঠোর পরিশ্রম করবে সে। শুরু হয় তার নতুন যুদ্ধ। বেঁচে থাকার এবং স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করার সে যুদ্ধে রাবিদ একা নয়, নন্দিনী ছিল তার পাশে।

তবে জীবনকে নতুন করে গোছানোর সময়ে জীবন থেকে হারিয়ে যায় তার অনেক কিছুই। অনেক বন্ধু-বান্ধব, অনেক মনোহর আড্ডা সব ছেড়ে দিতে হয় রাবিদকে। বেলা বারোটা থেকে মাঝরাত অবধি পত্রিকা অফিসে কাজ করে, আবার একটি অনুবাদ কেন্দ্রে কাজ করে রাবিদ। এক নামি গবেষকের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ঘরে বসে বসে সেই কাজ করতে হয় তাকে। নন্দিনী তখনো হলে থাকে। সেও একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরে। খুব ভালো রেজাল্ট নন্দিনীর। একটা চাকরি তার হওয়া অসম্ভব কিছু না। কিন্তু সে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নন্দিনীর পিঠে ভরসার হাত রাখতে পারে না রাবিদ। যেমন নন্দিনী রেখেছিলো তার পিঠে বিয়ের দুপুরে! এতো সব হৃদয় নিংড়ানো যুদ্ধে, হাড়ভাঙা পরিশ্রমে সোহেলের সঙ্গেও যোগাযোগ কমে যায় রাবিদের। কমে যাওয়া যোগাযোগ এক সময় বিচ্ছিন্নতায় রূপ নেয়।

এসবের মাঝে কেটে যায় অনেকগুলো বছর। এই সময়ের মধ্যে সবকিছু অনেকটাই গুছিয়ে আনে রাবিদ। নন্দিনীরও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি হয়। পছন্দের শিক্ষকতায় ঢুকতে পেরে বড় ভালো লাগে তার। সব মিলিয়ে ভালো আছে তারা। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন কোনো কোনো ভরদুপুরে অথবা মন খারাপ করা সন্ধ্যায় বড় একা লাগে রাবিদের। তখন সে বের হয়ে পড়ে অফিস ছেড়ে। হাঁটে এই পরিবাগ সড়ক ধরে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বসে জিরোয় পথের ধারের কোনো টং দোকানে অথবা ফুটপাতে। সেই রকম এক হণ্টন দুপুরে আজ দেখা হয়ে গেলো সোহেলের সঙ্গে। অনেক বছর পর।

আড্ডায় আড্ডায়, কথায় কথায়, গল্পে গল্পে দুই বন্ধুর সময় কেটে যেতে থাকে দ্রুত। একটার পর একটা সিগারেট পুড়ছে দুজনের হাতে। উজার হচ্ছে কাপের পর কাপ চা। কখনো দুয়েক চুমুক দেওয়ার পর ফেলে রাখছে তারা চায়ের কাপ। জুরিয়ে যাচ্ছে গরম ধোঁয়া ওঠা তরল চা। সেদিকে হয়তো খেয়াল নেই তাদের। সেই ঠান্ডা চা-ই গলায় ঢালছে তারা। মনে হচ্ছে যেন, আজ অনেক বছর পর ফিরে এসেছে সেই পুরোনো মনোহর আড্ডার দিন। কী এতো কথা তাদের? আমরা দূর থেকে শুনতে পাই না স্পষ্ট করে। তবে আবছা করে কানে আসে তাদের কথা। যতদূর শোনা যায়, সোহেল এখন লেখালেখি করে। এ থেকে ভালোই আয় হয় তার।
কই, বাজারে তো তোর লেখা কোনো বই দেখি না!
চায়ের কাপে বড় করে একটা চুমুক দিয়ে বলে রাবিদ। সোহেল কোনো কথা বলে না। শুধু মিটিমিটি হাসে।
কি রে, কথা কস না ক্যান? খুব অধৈর্য শোনায় রাবিদের গলা।
দোস্ত আমি ভূত লেখক! হাসতে হাসতে বলে সোহেল।
মানে কি? তুই ঘোস্ট রাইটিং করিস? কেন?
কেন করি শালা বোঝো না? কোনো একটা কাজ না করলে খাবো কি কইরা?
তাই বইলা একটা জীবন এমনে শেষ কইরা দিবি?
শোন দোস্ত, জীবনে চুরি ছাড়া আর সব কাম করতে পারি আমি। করসিও বিভিন্ন সময়। কিন্তু কোনো কিছুতেই মন বসাইতে পারি না। শুধু লেখালেখির কাজটাই খুব ভালো লাগে। করতেও পারি মনে হয় ভালোই। কিন্তু তোমগোর এই সার্টিফিকেটওয়ালা সমাজ আমারে স্বীকার করতে চায় না। আমার লেখা কোনো শালায় ছাপতে চায় না। একটা পাণ্ডুলিপি নিয়া গেসিলাম এক প্রকাশকের কাছে। তারে তুইও খুব ভালো কইরা চিনস। সেই শালায় আমার লেখা তো ছাপলোই না, উল্টা নানা রকম অপমানের কথা কইলো। ইচ্ছা করসিলো তার নাকে দুইটা ঘুষি লাগাই দেই। কিন্তু করি নাই কিছুই। শুধু বের হয়ে আসছি চুপচাপ। আমার সেই পাণ্ডুলিপিই যখন এক রাঘববোয়াল নিজের নামে জমা দিলো ওই একই প্রকাশকের কাছে—শালা গদগদ হইয়া ছাপাইসে। সবচেয়ে বড় কথা হইলো, বইটাও দেদারসে বেচা হইসে। আমি চিন্তা কইরা দেখলাম, এইটাই ভালো লাইন! লেখালেখি করলে আমার নাম হইবো। কিন্তু পেট তো ভরবো না! তাই হইয়া গেলাম ভূত লেখক!

অনেকটা সময় নিয়ে কথাগুলো বলে সোহেল। কথা শেষ হতেই ঠা ঠা ঠা হাসিতে কাঁপিয়ে তোলে চারপাশ। আশপাশের লোকজন অবাক চোখে তাকায় তাদের দিকে। রাবিদের কেমন অস্বস্তি লাগে। তাকিয়ে দেখে হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এসেছে সোহেলের। নিভে গেছে হাতের সিগারেট। সেই নিভে যাওয়া সিগারেটেই লম্বা করে টান দেয় সে! এমন সময়, হঠাৎ বেজে ওঠে সোহেলের সেলফোন। ফোন রিসিভ করে সোহেল বলে, পরীবাগ সড়কে আইসা পড়েন। আমি চায়ের দোকানে আছি।

মিনিট দশেক পরে একটি দামি গাড়ি এসে থামে তাদের থেকে একটু দূরে। রাবিদকে দেখিয়ে সোহেল বলে, লেখক সাহেব গাড়ি পাঠাইসে। তার বউয়ের নামে একটা বই ছাপাবে। প্রেমের গল্প। যাই লেখাটা দিয়ে আসি!
যাইস একটু পরে। আর কিছুক্ষণ কথা বলি চল। অন্যমনস্ক সুরে বলে রাবিদ।
ঠিক আছে, গেলাম না হয় আরেকটু দেরি কইরা!
তারপর দুই বন্ধু বসে থাকে। কিন্তু তাদের আলাপ আর জমে না। দুজনের মাঝখানে কোনো কারণ ছাড়াই আজন্মের নীরবতা নামে।
হঠাৎ কবিতা আওড়াতে থাকে সোহেল—
তোমার আঁচল কাল উড়েছিল মেঘে
পৃথিবী পেয়েছিল ছায়া।
আজ তুমি মেঘ, আকাশে সাঁতার কাটো
রাজহংসীর কায়া।
বল তো দোস্ত কার লেখা?
পূর্ণেন্দু পত্রী। সংক্ষেপে উত্তর দেয় রাবিদ।
এবার সোহেল আর কোনো কথা না বলে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় পাশেই পার্ক করে রাখা কালো রঙের গাড়িটার দিকে। রাবিদ অবাক চোখে চেয়ে থাকে সোহেলের চলে যাওয়া পথের দিকে। তার কেন জানি খুব ক্লান্ত লাগে।

চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে আকাশের দিকে চোখ রাখে সে। নীল আকাশে বড় বড় সাদা মেঘ। কোথায় যেন ভেসে ভেসে যাচ্ছে। রাবিদের মনে হয় নীল আকাশে অগনন সাদা রাজহংসীর মেলা বসেছে!

সর্বশেষ
জনপ্রিয়