ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

যেভাবে দিনমজুর থেকে ফুটবল তারকা হলেন মারিয়া মান্দা

স্পোর্টস ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:৪৫, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২  

মারিয়া মান্দা

মারিয়া মান্দা

কলসিন্দুর৷ এই নামটি শোনা মাত্রই চোখে ভেসে উঠে একদল নারী ফুটবলারের মুখ। সাফ স্বর্ণজয়ী নারী ফুটবল দলের আট সদস্যের বাড়ি এই কলসিন্দুরেই। তাদের কল্যাণেই কলসিন্দুর এখন পরিচিত দেশব্যাপী। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার গামারীতলা ইউপির একটি গ্রাম এই কলসিন্দুর। এই গ্রামেই বসবাস ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি গারো পরিবারের মেয়ে মারিয়া মান্দা।

বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত 'নেতাই' নদীর পাড়ে থাকে মারিয়া মান্দার পরিবার। ফুটবলের কল্যাণে মারিয়াকে এখন সবাই চেনে। কিন্তু না, রাতারাতি কোনো আলাদিনের চেরাগ পেয়ে মারিয়া সফল হয়নি। তার এই সফলতার পেছনের গল্প হার মানাবে যেকোনো সিনেমার গল্পকেও!

নেতাই নদী পার হয়ে দেড় কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যাওয়ার পর মান্দির কোনা পাড়ায় মারিয়ার মায়ের টিনের ভাঙ্গাচোরা বাড়ি। একটু জোরে দমকা হাওয়া এলেই বাড়িসুদ্ধ লুটিয়ে পড়তে পারে মাটিতে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবার হওয়ায় মারিয়ার মা এনোতা মান্দা বীরেন্দ্র মারাককে বিয়ে করে নিজ বাড়িতে এনেছিলেন। মারিয়ার বয়স যখন তিন বছর তখন তার বাবা মারা যায়।

ঘরে তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে জীবন সংগ্রামে নামেন মারিয়ার মা এনোতা মান্দা। বন্ধ হয়ে যায় বড় মেয়ে হাসি মান্দার স্কুলে যাওয়া। মেঝো মেয়ে পাপিয়া মান্দা কোনদিনই স্কুলে যেতে পারেনি। সংসার চালাতে ঢাকায় গৃহপরিচারিকার কাজে দেয়া হয় হাসি মান্দা ও পাপিয়া মান্দাকে। ছোট ভাই ডানিয়াল মান্দা তখন মায়ের কোলে। নিজেদের কোনো জমিজমা নেই। কিছু খাস জমি চাষাবাদ ও অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চানিয়েছেন এনোতা মান্দা।

চরম অভাব অনটনের সঙ্গে লড়াই করেই বড় হতে থাকে মারিয়া মান্দা। মা ও বড়বোন মিলে তাকে ভর্তি করে দেয় কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তখন থেকেই খেলাধুলার দিকে ঝোঁক তার। 'দৌড়' খেলায় বিশেষ পারদর্শী ছিল মারিয়া। বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের জন্য যখন কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী ফুটবল টিম গঠনের কাজ শুরু করেন প্রধান শিক্ষক। তখন ডাক পড়ে দৌড়ে পারদর্শী মারিয়া মান্দার। এখান থেকেই শুরু নতুন যাত্রার।

কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল বলেন, মারিয়াকে যখন দলে নেয়া হয় তখন সে মাত্র তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার বাড়ি একেবারেই প্রত্যন্ত এলাকায় হওয়ায় স্কুল ও খেলার অনুশীলনে যাওয়া-আসার সমস্যাটা ছিলো বড়। তার বাবা নেই, ঘরে অভাব অনটন। এ অবস্থায় খেলায় নেয়ার জন্য মারিয়ার মাকে অনেক বোঝাতে হয়েছে। মেয়ের আগ্রহ আর মায়ের পরিশ্রমে আজকের মারিয়া মান্দা। যার পরিচয় সে আমার ছাত্রী নয়, বরং আমি তার শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। আজ প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলসিন্দুর স্কুলকে দেশের মানুষ মারিয়া, সানজিদাদের জন্য চেনে।

২০১৩ সালে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। তখন কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে ছিলেন মো: মফিজউদ্দিন। নারী ফুটবলারদের খেলা শেখানো ও প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এই টুর্নামেন্টটি খালি পায়ে খেলার সুযোগ ছিলো।

শিক্ষক মো. মফিজউদ্দিন বলেন, যখন দেখলাম খালি পায়ে খেললে সামনে আরো বড় টুর্নামেন্ট খেলা সম্ভব হবে না তখন বুট পরে খেলা শেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া মারিয়ার ফুটবল খেলার বুট ছিলো না।  আমার কাছ থেকে দুই দিনের ছুটি নেয় সে। সেই দুই দিন অন্যের কৃষি জমিতে ধান রোপণের জন্য দিনমজুরের কাজ নেয় সে। কাজ করে তিনশ টাকা মজুরি পেয়ে সেই টাকা দিয়ে কেনে বুট জুতা। নতুন জুতা আমাকে যখন দেখাতে আনে, তার মুখের আনন্দের হাসিটি এখনো আমার মনে আছে।

মো. মফিজউদ্দিন আরো বলেন, পরে যখন জানতে পেরেছি ফুটবলের বুট জুতা কেনার জন্য অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করেছে চতুর্থ শ্রেণির এই ছোট্ট মেয়ে, তখন খারাপ লেগেছে। খেলার জন্য প্রয়োজন শক্তি, সেজন্য দরকার পুষ্টসমৃদ্ধ খাবার। তখন প্রয়োজন ছিলো মারিয়ার জন্য উন্নত খাবার। কিন্তু তখন কেউ এগিয়ে আসেনি, খালি পেটে বা অর্ধ খালি পেটে খেলতে হয়েছে মারিয়াকে।

যে জনপদে ছিলো ধর্মীয় গোড়ামি ও বাল্য বিয়ের প্রচলন সেখানে মারিয়ার ফুটবল খেলার পথ মোটেই সহজ ছিলো না। মারিয়ার বোন পাপিয়া মান্দা বলেন, যখন দেখলাম গ্রামে থেকে কাজ করেও সংসার চলছে না, তখন আমিও ঢাকায় মানুষের বাসায় কাজ করতে চলে যাই। বছরে একবার বড়দিনের সময় আসতাম বাড়িতে। মারিয়া আর আট দশটা মেয়ের মতো বড় হতে পারেনি। এখন এত অল্প বয়েসে সংসারের হাল ধরেছে সে।

মারিয়ার বড় বোন হাসি মান্দা বলেন, প্রতিবেশিরা অনেকে অনেক কিছু বলেছে। এলাকায় মেয়েদের ফুটবল খেলার প্রচলন নেই দেখে মারিয়াকে অন্যচোখে দেখতো তারা। মেয়ে মানুষ ফুটবল খেলে কি হবে এইসব বলতো। তখন আমি মারিয়াকে বলতাম, মানুষের কথায় কান দিও না, তুমি খেলা চালিয়ে যাও। শুরুতে প্রতিবেশিরা যারা মারিয়াকে টিটকারি টিপ্পনি দিত, এখন তারাই উৎসাহ দেয়, মারিয়া ভালো খেললে উল্লাস করে। এটা দেখে ভালো লেগেছে।

মারিয়ার মামা জেফ সাংমা বলেন, মারিয়ারা আগে একটি কুড়ে ঘরে থাকতো। তাদের অসহায় অবস্থা দেখে ২০০৮ সালে কারিতাস নামক এক্টি এনজিও একটি টিনের ঘর করে। বর্ষায় যখন নদীতে পানি বেশি হয়ে যেত, তখন অনেক সময় সাঁতরে নদী পার হয়ে স্কুল মাঠে গেছে মারিয়া। খেলা তার জীবনের সব। তিনি জানান সম্প্রতি দুই কাঠা জমির মালিক হয়েছে মারিয়ার মা। আর কিছু খাস জমিতে নিজেই ধান চাষ করে চলছে সংসার।

জেলা পর্যায়ের ডিএফএ টুর্নামেন্টের সময় বাফুফে কর্মকর্তাদের নজরে আসে মারিয়া। ডাক পড়ে অনুর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলার জন্য। মারিয়া পাড়ি জমায় ঢাকায়। ২০১৪ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে মারিয়া মান্দা বেশ ভালো পারফরমেন্স দেখায়। পরের বছরই তাজিকিস্তানে অনুর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টে অংশ নেয় মারিয়া। সেখানেও সেরা পারফরমেন্স, এবারও চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। মারিয়া সেখানে সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করে।

২০১৬ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এএফসি অনুর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টের বাছাই পর্বের খেলায়ও ছিলো মারিয়ার আধিপত্য। অনুর্দ্ধ-১৫ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের অধিনায়কের দায়িত্ব পায় মারিয়া। অত্যন্ত দক্ষতা আর নিজের নিখুঁত ফুটবল খেলা দিয়ে মারিয়া বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব। এরপরের গল্পের সাক্ষী তো দেশের সবাই!

সর্বশেষ
জনপ্রিয়