ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সম্রাট আকবর-বাবর-শাজাহানের ডেরায়

বাবর আলী

প্রকাশিত: ১২:১৫, ১ মে ২০২৩  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বাবর আলী। পেশায় চিকিৎসক, নেশায় পর্বতারোহী। সাইক্লিং, ম্যারাথন রানও তার সঙ্গী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। সম্প্রতি তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে জয় করেছেন হিমালয়ের সাড়ে ২২ হাজার ফুটের ভয়ংকর চূড়া ‘আমা দাবালাম’। এর আগে হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সাইকেল চালিয়ে দেশের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু কৃতিত্ব। এবার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন বৈচিত্র্যময় দেশ ভারতে। ভূ-স্বর্গখ্যাত কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে বানিহাল, উধমপুর, জম্মু, পঠানকোট হয়ে দিল্লি ও আগ্রা। পরে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র, ঝাঁসী পেরিয়ে প্রবেশ তেলঙ্গানায়। এর পরে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক হয়ে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীতে সফর শেষ হবে। তার হিসাবে সব মিলিয়ে ৪৫ দিনে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সফর করবেন তিনি।
এই সফরের প্রতিদিনের গল্প থাকবে জাগো নিউজে। আজ থাকছে ত্রয়োদশ পর্ব।

দিন ১১। ‘টয়লেট কোথায়?’ধাবার ছোকড়াকে রাতে প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তর এলো, ‘বোতল উঠাও অর জঙ্গল মে যাও!’ এবার খেয়াল করলাম এই ধাবায় আসলেই টয়লেট নেই! অবশ্য ঝোপ আছে অদূরেই। রাতে বোতল হাতে এক ট্রাক ড্রাইভারকে ওদিকে যেতেও দেখেছি। রাইড শুরু করতেই বোতল হাতে রাস্তা পেরোতে অপেক্ষমাণ লোকেদের দেখা পাচ্ছিলাম। একটু ভালোমতো পাশের ক্ষেতে খেয়াল করতেই খোলা জায়গায় কাজ সারা লোকের দেখাও পাওয়া যাচ্ছে!

মোদীর ‘স্বচ্ছ ভারত’ ক্যাম্পেইন উত্তর প্রদেশের কিছু লোকের জন্য গরুর গাড়ি নিয়ে মহাকাশযাত্রার মতো অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে। দিল্লি থেকে উত্তর প্রদেশের আগ্রার দূরত্ব প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে এদের মননের দূরত্ব ২৫০ আলোকবর্ষ। এই দূরত্ব কি এই জন্মে ঘুচবে?

লোকের বোতল আর লোটা হাতে রাস্তা পারাপার দেখতে দেখতে মাখদুম। রাজপুরা জাট থেকে এগিয়ে কিথাম লেকের রাস্তা ধরলাম। ভুল রাস্তায় চলে এসে ভুল দৃশ্যের সামনে! রাস্তার ধারেই চারটা বাচ্চা বসে পড়েছে! একে অপরকে আবার পাথরও ছুড়ছে। স্তূপীকৃত মানবনির্যাসে পাথর পড়ে গায়ে ছিটকে আসার ভয়ে তাড়াতাড়ি উলটো দিকে পালালাম। বাইপাস সড়কের আগে রাস্তার ধারেই ময়ূরের দেখা। গম ক্ষেতে কী যেন খুঁটে খাচ্ছে লম্বা পুচ্ছ ঝুলিয়ে। গন্তব্য সুর সরোবর। পৌঁছে হতাশ হতে হলো। প্রবেশপথ খুলতে আরও দেরি আছে। এই জায়গায় একটা ভাল্লুক রেসকিউ সেন্টারও আছে। বেশি ভোরে বেরোনোতে জায়গাটা দেখা হলো না।

প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে চলে এলাম সিকান্দ্রা। সম্রাট আকবরের সমাধির জন্য বিখ্যাত এই সিকান্দ্রা। বিশাল চত্বর পেরিয়ে তবেই সমাধি কমপ্লেক্সের গেট। অন্য মোগল সম্রাটদের তুলনায় সম্রাট আকবরের শাসনকাল বেশ দীর্ঘ। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে তিনি শাসন করেছেন কাবুল থেকে আসাম, কাশ্মীর থেকে আহমেদনগর। প্রথমদিকে যদিও কিশোর সম্রাটের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে ছিলেন বৈরাম খান। নিজের কবরের স্থাপত্য কেমন হবে সেটাও আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। অবশ্য সমাধি কমপ্লেক্সের কাজ শেষ হওয়ার আগেই তাকে কবরস্থ হতে হয়।

পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর পরবর্তীসময়ে সমাধির কাজ শেষ করেন ১৬১২ সালে। মোজাইক আর লাল স্যান্ডস্টোনে তৈরি ফটক পেরিয়ে মূল সমাধির প্রাঙ্গণ। ফটকের মিনারগুলোর সঙ্গে মার্বেল পাথরে তৈরি ছাতিও আছে। দুপাশের বাগানে যত্নের ছাপ। এই বাগিচা তৈরি করেছিলেন আকবরের প্রিয়তম স্ত্রী মনির-উজ-জামানী। কিলোমিটার খানেক দূরে তিনিও চিরশায়িত।

বাগানে প্রচুর ময়ূর আর কাঠবিড়ালি। ময়ূর নিজ মনে ঘাসে ঘুরে বেড়ালেও কাঠবিড়ালির চাঞ্চল্য আর হুটোপুটি চোখে পড়বেই। মূল সমাধির ভবনটাতে প্রবেশ করলেই একটা টানেল মতো পড়ে। আধো আলো-আঁধারিতে টানেলের শেষ মাথায় শুয়ে আছেন এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুঘল সম্রাট আকবর। শ্বেত পাথরে মোড়া কবরের সামনে কারা যেন পয়সা দিয়ে গেছে! সমাধি কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে গেলাম কাচ মহলের দিকে, পুরো ভবনে যদিও কোনো কাচ নেই। কালের ক্ষয়ের কারণেও হতে পারে। চত্বরজুড়ে অসংখ্য তাল আর নিম গাছ। সজনে, ডুমুর আর দেওদারও কম নয় একেবারে। নিমগাছ আর সজনে গাছের বেড় তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। সাধারণত এমন মোটা গুঁড়ির এই দুই গাছ চোখে পড়ে না। হোয়াটসঅ্যাপে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে নিলাম এক ফাঁকে।

সিকান্দ্রার আকবরের সমাধি থেকে বেরিয়ে জায়গার নাম পড়লো বাবরপুর! মোগলদের আস্তানায় পা রেখেছি বলে কথা! পরের গন্তব্য আগ্রা ফোর্ট। মাঝে পড়লো খাটু শ্যাম জি মন্দির। প্রচণ্ড ভিড় ছোট্ট এই মন্দিরে। এখান থেকে যমুনা নদীর একদম পাশঘেঁষে রাস্তা। অবশ্য যমুনার অবস্থা বেহাল। শহরের পয়ঃপ্রণালীর কালচে বিষাক্ত পানি গিয়ে মিশছে যমুনার প্রবাহে। নদীখাতও রুগ্ন, শীর্ণ। নদী আর নদী নেই, হয়ে গেছে খাল। মহিষের দল নোংরা পানিতে গা ডুবিয়ে দাবদাহ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছে। আমাদের দেশের যমুনার মতোই নদীর দুই পাশেই বিশাল চর পড়েছে। বাড়িতে কথা বলার পর থেকে ঈদের দিনে একটু মিষ্টির জন্য মনটা আনচান করছে। আগ্রার বিখ্যাত পেঠার দোকান প্রতি মোড়ে। এক ধরনের কুমড়ো থেকে বানানো অনেকটা মোরব্বার মতো এই মিষ্টি আগে চাখা হয়নি। দুই-চারটা চাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কোনো দোকানি ৫০০ গ্রামের নিচে এই জিনিস বিক্রি করে না। অগত্যা সকালের নাশতা হিসেবেই ৫০০ গ্রাম পেঠা কিনে নিলাম। দামও খুব বেশি নয়।

পেঠা অনেক ধরন আর গড়নের হয়। আসল তথা সাদা পেঠা থেকে শুরু করে, কেসর পেঠা, চকলেট পেঠা, কাজু পেঠা থেকে মায় পান পেঠা পর্যন্ত। আমি নারকেল পেঠার ওপর আস্থা রাখলাম। জিনিসটা শুধু একটু বেশি মাত্রায় মিষ্টি, অন্যথায় খেতে ভালো।

যমুনা নদীর পাড়ঘেঁষা রাস্তার নাম ‘যমুনা কিনারা’ রোড। বেশ পরিচ্ছন্ন রাস্তা। সবচেয়ে ভালো লাগলো শুকনো এবং ভেজা- এই দুই ধরনের আবর্জনার জন্য আলাদা ডাস্টবিন দেখে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, আবর্জনার পৃথকীকরণ। উৎসে এটি করা গেলে অনেক বর্জ্যই পুনঃচক্রীকরণ সম্ভব। বাংলাদেশে রাস্তাঘাটে প্লাস্টিকের পেট বোতল অহরহ। শহর পেরিয়ে দুর্গম পাহাড়ের কন্দরেও আজকাল এদের উপস্থিতি। কিন্তু পেট বোতল রিসাইকেলের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে পেট বোতল পায় না শুধু পৃথকীকরণের অসুবিধার জন্য।

যমুনা তট থেকে কিছুদূর এগিয়ে আগ্রা ফোর্ট। বিশাল এক লাল বেলেপাথরের তৈরি প্রতিরক্ষা প্রাচীর ঘিরে রেখেছে একে। এটি ভারতবর্ষের একমাত্র দুর্গ, যেখানে প্রথমদিকের সব মোগল সম্রাট কিছুদিনের জন্য হলেও বসবাস করেছেন। এমনকি সম্রাট হুমায়ুনের রাজ্যাভিষেকও হয়েছে এই দুর্গে। ভেতরে ঢুকতেই এক স্প্যানিশ গাইড ব্যাটার বকবকানিতে কান খোলা রাখা দায়। ইস! চোখের মতো চাইলেই কানটা যদি পুরোপুরি বন্ধ করা যেত!

দুর্গের প্রাচীর থেকে যমুনা নদী দৃশ্যমান। দুই কিলোমিটার দূরের তাজমহলও খুব ভালোভাবে দেখা যায় দুর্গ থেকে। স্প্যানিশ গাইড ছাড়াও আছে নানাভাষী গাইড। এরা পিছু নিচ্ছে নানানভাবে। খাস মহল আর রোশানারার ঔজ্জ্বল্য পেরিয়ে বাবরের তৈরি সিঁড়িযুক্ত কুয়ো। আঙ্গুরি বাগ ছাড়িয়ে অন্য মোগল স্থাপত্যের মতো সুদৃশ্য বাগান। অন্য সব মোগল সম্রাটরা এই দুর্গে বসবাস করলেও লাল বেলেপাথরে দুর্গটি পুননির্মাণের কৃতিত্ব সম্রাট আকবরের।

আকবরের শাসনামলে দুর্গের অভ্যন্তরে ৫০০ এর অধিক প্রাসাদ ছিল। এর অনেকগুলো আকবরের নাতি শাহজাহানের শ্বেত পাথর প্রীতির হাতে ধ্বংস হয়। লাল বেলেপাথরের প্রাসাদ হটিয়ে শ্বেতপাথরে একের পর এক প্রাসাদ খাড়া করেন শাহজাহান। বাকি প্রাসাদগুলো ধ্বংস হয় ব্রিটিশদের হাতে। ব্যারাকের সৈন্যদের স্থান সংকুলান করতে তারাও বেশকিছু ভবন ধ্বংস করে। এখন সব মিলিয়ে অবশিষ্ট আছে ৩০টির মতো প্রাসাদ।

আগ্রা ফোর্ট থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থান তাজমহলের। পার্কিং থেকে ৭০০ মিটার হেঁটে যেতে হয় টিকিট কাউন্টারে। অবশ্য ২০ রুপির বিনিময়ে গলফ কার্টও মেলে। গতর খাটানোতে অনিচ্ছুকরা শরীর ডুবিয়ে দিচ্ছে গলফ কার্টের নরম সোফায়।

আগ্রার সব দ্রষ্টব্যের টিকিট অনলাইনে আগেই কাটা যায়। আমি অবশ্য সে ঝামেলায় যাইনি। বিদেশি হওয়ার অসুবিধায় স্থানীয়দের চেয়ে প্রায় এগারো গুণ দামে টিকিট কিনতে হলো। অবশ্য সার্কভুক্ত দেশ হওয়ায় ফাঁড়া কম। সার্কভুক্ত দেশগুলো বাদে অন্যদের গুনতে হয় আরও বেশি টাকা। বিশাল লাইন পেরিয়ে ঢুকতে পারলাম তাজমহলে। অন্য দ্রষ্টব্যগুলোর তুলনায় অসম্ভব ভিড়। সিকিউরিটি চেকের দায়িত্বে থাকা লোকটা জিজ্ঞেস করলো ব্যাগে থাকা পানির বোতলে কী? আমি জবাব দিলাম পানির বোতলে পানিই। সে স্মিত হেসে আবার প্রশ্ন করলো, ‘দুসরা পানি তো নেহি হে?’ অবশেষে বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটির প্রাঙ্গণে পা রাখলাম।

সব মোগল প্রাসাদের মুকুট হিসেবে অভিহিত করা হয় মমতাজ মহল ও শাহজাহানের এই সমাধি কমপ্লেক্সকে। শাহজাহানের সাদা মার্বেলের প্রতি অনুরাগ এই মহলকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। ভিড় ঠেলে লোকজনকে ধরে কয়েকটা ছবি তোলা গেলো। মূল সমাধি ছাড়াও তাজের কমপ্লেক্সে আছে মসজিদ, মেহমান খানা। একপাশে তাজ জাদুঘরও আছে। সঙ্গে নহবতখানাও। দূষণের হাত থেকে তাজমহলকে রক্ষার সরকারি উদ্যোগ একে এখনো শ্বেতই রেখেছে। বেরোলাম পূর্ব ফটক হয়ে। তাজের গেটের পাশে অনেক মুসলিম বসতি। ঈদের দিনে একটা ছোটখাটো মেলার মতো বসেছে। বাচ্চাদের শোরগোলে সরগরম জায়গাটা। আগ্রা দেখে একটা ব্যাপারই বারবার মনে হলো- আসল মোগল আর তাদের স্থাপনাগুলো সব আগ্রায়! আমরা যা পেয়েছি সুবেদার কিংবা তাদের তাবেদারদের ছিটেফোঁটা। বিদেশি কোটায় আগ্রার মোগল স্থাপনাগুলোর টিকিট কিনতে কিনতে পকেট হালকা হলেও চোখের আর জানার ভাণ্ডার বেশ ভারী হয়েছে।

ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটা এখন একের ওপর। মোগল স্থাপনার সঙ্গে পরিচিত হতে গিয়ে সকাল থেকে সাইকেল চালানো হয়েছে কম। সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর একটা অবধি সিকান্দ্রা আর আগ্রাতেই কেটে গেলো। এবার যাত্রা গোয়ালিয়র রোড হয়ে। চলতি পথে আমি সাধারণত রাস্তার সাইনবোর্ড আগ্রহ নিয়ে পড়ি। জায়গা চিনতেও ব্যাপারটা সাহায্য করে। আব্বু ছোটবেলায় এই ব্যাপারটা শিখিয়েছিল। কিন্তু আজ কোনোভাবেই জুত করতে পারছি না। রাস্তার বেশিরভাগ লেখা হিন্দিতে। ভাষাটা চলনসই বলতে পারলেও অক্ষরজ্ঞানের অবস্থা নাজুক। কাকুয়া ছাড়াতেই রাস্তার দুই ধার সজনে, শিশু আর নিম গাছের দখলে। তবে এই রাস্তায় গাড়ি অপেক্ষাকৃত কম। চলতে চলতেই এক জায়গায় মাইফলক দেখলাম ‘কন্যাকুমারী ২৪৮৯ কিমি’! প্রথমবারের মতো কন্যাকুমারীর দূরত্বসূচক মাইলফলক।

এই রাস্তাটা ধরে চলতে চলতে মনে হচ্ছে দেশের মহাসড়কে চলছি। ধীরে ধীরে নম্বর প্লেটে RJ অক্ষর দুটির উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এই RJ কিন্তু রেডিও জকি নয়, রাজস্থান। উটাঙ্গন নামক নদের ওপরের সেতু ছাড়াতেই উত্তর প্রদেশ ছাড়িয়ে প্রবেশ করলাম রাজস্থানে। কড়া সূর্যতাপ থেকে বাঁচতে আগে মেয়েদের চোখেমুখে কাপড় বাঁধা দেখেছি। রাজস্থানে প্রবেশ করে রোদের কারণে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সবার চোখেমুখে কাপড়। রাস্তার ধারে লালিমার জোগান দিচ্ছে কৃষ্ণচূড়া গাছ। টানা চালিয়ে চারটায় পৌঁছে গেলাম ঢোলপুর। চম্বল নদের তীরে অবস্থিত ঢোলপুর রাজস্থানের জেলা শহর। আজ রাস্তায় অনেক ছাড়া গরু চোখে পড়ছে। মহাসড়কে দাঁড়িয়ে পড়ছে কেউ, কেউবা রাস্তার পাশের আবর্জনায় মুখ বাড়িয়ে খাবারের সন্ধান করছে। ঢোলপুর ছাড়িয়ে হাতের বামে বাঁক নিয়ে মহাসড়ক ছাড়লাম। উদ্দেশ্য শাহগড় দুর্গ দেখা। আধা কিলোমিটারের রাস্তা কঠিন পরীক্ষা নিলো।

রাস্তায় পিচ কিংবা ইট নেই, আছে মিহি ধুলোর পুরু আস্তরণ। স্থানীয় পাথরের ব্লকে বানানো দুর্গের প্রায় ভগ্নদশা। প্রতিরক্ষা দেওয়াল আছে দুর্গ ঘিরে। প্রতিরক্ষা দেওয়াল অবশ্য নিজেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ। ধসে পড়েছে জায়গায় জায়গায়। মূল দুর্গের ফটক লাগোয়া অংশে তাও ধ্বংসের ছোপ পড়েনি। ফোঁকরগুলো কবুতরের দখলে। দুর্গের ওপরের অংশে মানববসতি আছে। এর বয়সের সঠিক গাছপাথর জানা না গেলেও জানা যায় হুমায়ুনকে ক্ষমতাচ্যুত করা শেরশাহ সুরি ১৫৪০ সালে এই দুর্গ পুনর্নির্মাণ করেন। চারপাশে মাটির সব টিলার মাঝে স্থানীয় ইটে তৈরি এই দুর্গ দেখতে বেশ লাগে।

এগিয়েই পড়লো চম্বল নদ। এই নদই রাজস্থান আর মধ্য প্রদেশের সীমানা। আমাদের দেশেও নদী-খাল দিয়ে জেলা-উপজেলার সীমানা নির্ধারণ বহুল প্রচলিত। চম্বল আমাকে মুগ্ধ করলো। ঝিলাম নদের পর অনেকদিন বাদে অন্য একটা নদ দেখে মন ভরলো। সেতুর মাঝের ফোঁকরগুলোতে পলিথিনে বেঁধে কী সব রাখেছে লোকেরা। সম্ভবত কোনো মানতের অংশ। সব কয়টা ফোঁকরেই পলিথিনের উপস্থিতি। ব্যাপারটার সুরাহা করতে পারলাম না অবশ্য। আকাশেজুড়ে ছিঁড়েখোড়া সাদা মেঘ মাঝে মধ্যেই সূর্যকে ঢেকে দিয়ে স্বস্তি দিচ্ছে।

মধ্য প্রদেশে প্রবেশের পর থেকে গোবরের তৈরি অসংখ্য কুঁড়েঘর চোখে পড়ছে। প্রায় প্রতিটা বাড়ির সামনেই এই বস্তু আছে। খানিকটা এগিয়ে রাস্তার ধারের সুদৃশ্য এক জৈন মন্দিরের ছবি তুলছি, এসময় এক চায়ের দোকানি কথা বলতে এলো। ফাঁকে চায়ের আমন্ত্রণ। ভ্রমণের আদ্যোপান্ত শুনে বেশ বাহবা দিলো। পয়সা দিতে যেতেই উত্তর এলো, ‘ম্যায় ইয়াত্রি সে পয়সা নেহি লেতা।’ ধন্যবাদ দিয়ে টানা চালিয়ে মোরেনা। মোরেনা শহরের শেষে আবর্জনার বিশাল স্তূপ। শহরবাসীর উচ্ছিষ্টে খুব ভালো ভোজ হচ্ছে কুকুর আর কাকের। শহর পেরিয়ে যেতেই চোখ খুঁজে রাত্রিবাসের উপযোগী কোনো ধাবা। সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসার আগেই পৌঁছাতে হবে তেমন কোনো আশ্রয়ে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়