ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৫ ১৪৩০

সাজেক ভ্রমণে কখন যাবেন? কম খরচে থাকবেন ও খাবেন কোথায়?

ইসতিয়াক আহমেদ

প্রকাশিত: ১২:২১, ২৩ নভেম্বর ২০২২  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার ফকিরাপুল থেকে রাত ১১টায় রওনা হয়ে খাগড়াছড়ি যখন পৌঁছালাম তখন সকাল ৭টা প্রায়। নেমেই সবাই ফ্রেশ হয়ে নিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। কারণ যেতে হবে আজ অনেকটা পথ। সকালের নাস্তা করেই মূলত চড়ে বসা চান্দের গাড়িতে।

এখন খাগড়াছড়ি থেকে চান্দের গাড়ি চলে সিরিয়াল অনুসারে। এর ভাড়া দিন, ভ্রমণ স্থান ও গাড়ির আকার অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন। গাড়িতে চড়েই বিস্ময়কর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে সবাই মিলে ছুটলাম দীঘিনালার উদ্দেশ্যে।

সাজেক যেতে হয় সেনাবাহিনীর এসকোর্টে। দীঘিনালা থেকে সেনাবাহিনীর এসকোর্ট শুরু হয় সকাল ১১টায় ও আরেকটি শুরু হয় বিকাল ৩টায়। একই ভাবে সাজেক থেকে সকাল ১০টায় ও বিকেল ৩টায় আর্মির এসকর্ট শুরু হবে।

আপনাকে এই এসকর্ট এর সঙ্গে যেতে আসতে হবে। সকালের এসকোর্ট ধরতে না পারলেও বিকেলের এসকর্টে যেতে পারবেন, তবে বিকেলের এসকর্ট মিস করলে পরের দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

সাজেক ভ্যালি রাঙামাটি জেলার সর্বউত্তরের মিজোরাম সীমান্তে অবস্থিত। সাজেক হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন, যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। এর উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা।

এটি রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত হলেও এর যাতায়াত সুবিধা খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে সাজেকের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার ও দীঘিনালা থেকে ৪৯ কিলোমিটার। বাঘাইহাট থেকে ৩৪ কিলোমিটার।

খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালা আর্মি ক্যাম্প হয়ে সাজেক ভ্যালি যেতে হয়। পথে পরবে ১০ নং বাঘাইহাট পুলিশ ও আর্মি ক্যাম্প, যেখান থেকে আপনাকে সাজেক যাবার মূল অনুমতি নিতে হবে।

তারপর কাসালং ব্রিজ, ২টি নদী মিলে কাসালং নদী হয়েছে। পরে টাইগার টিলা আর্মি পোস্ট ও মাসালং বাজার। বাজার পার হলে পরবে সাজেকের প্রথম গ্রাম রুইলুই পাড়া।

সাজেক রুইলুইপাড়া, হামারিপাড়া ও কংলাকপাড়া, এই ৩টি পাড়ার সমন্বয়ে গঠিত। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত রুইলুই পাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১,৭২০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত আর কংলাক পাড়া ১,৮০০ ফুট উচ্চতায় কংলাক পাহাড়ে অবস্থিত।

সাজেকে মূলত লুসাই, পাংখোয়া এবং ত্রিপুরা উপজাতি বসবাস করে। রাঙামাটির অনেকটা অংশই দেখে যায় সাজেক ভ্যালি থেকে। এই জন্য সাজেক ভ্যালিকে রাঙামাটির ছাদ বলা হয়। কর্ণফুলী নদী থেকে উদ্ভূত সাজেক নদী থেকে সাজেক ভ্যালির নাম এসেছে।

সাজেকে বর্তমানে গড়ে উঠেছে শত শত রিসোর্ট যার কোনোটি বাংলাদেশ ভিউয়ের, আর কোনোটি মিজোরাম ভিউয়ের। এ যাত্রায় আমরা ঘুরুঞ্চি টিম উঠেছি গসপেল রিসোর্টে। সাজেক ভ্যালির অনেক রিসোর্টে মাঝে প্রিমিয়াম ভিউয়ের এক রিসোর্ট হলো গসপেল রিসোর্ট। দ্বিতল এই রিসোর্টে আছে ১০টি রুম।

এর মাঝে ভিউওয়ালা প্রিমিয়াম রুম আছে ৬টি আর আর ইকোনমিক ক্লাস রুম আছে ৪টি। এই রিসোর্টে প্রিমিয়াম রুমগুলোর উপর তলার ৩টি রুমের সাথে আছে প্রাইভেট বারান্দা। আর নিচ তলার ৩ টি রুমের প্রতিটির সাথে যুক্ত আছে বাংলাদেশের ভিউ।

এই রিসোর্টের বারান্দা অনেক বড়। যা কিনা বন্ধু ও পরিবারের সবাইকে নিয়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য অসাধারণ জায়গা। যদি চান তবে হ্যামকে ঝুলে কাটিয়ে দিতে পারেন পুরো একটা বেলা। ৩০০০-৪০০০ টাকার মাঝে পেয়ে যাবেন এই রিসোর্টের রুমগুলো। রাতের গসপেল কিন্তু একটু বেশিই সুন্দর।

সাজেক পৌঁছেই সবাই ফ্রেশ হয়ে পেট ঠান্ডা করতে চলে গেলাম পাশের বিসমিল্লাহ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে। ব্যাম্বু চিকেন, অসাধারণ পাহাড়ি সবজি, ডাল, ভর্তা-ভাত দিয়ে দুপুরের খাবার ভরপুর খেলাম সবাই। অসাধারণ যে খাবারের স্বাদ।

প্রতিবেলায় নানা পদের খাবারের আয়োজন থাকে এখানে। সাজেক যাওয়ার আগেই এই রেস্টুরেন্টে কল দিয়ে নিজেদের প্যাকেজও তৈরি করে নিতে পারবেন। টিম ঘুরুঞ্চি বা ইসতিয়াকের রেফারেন্স দিলে আকর্ষণীয় ডিসকাউন্ট অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য।

খেয়ে দেয়ে হালকা রেস্ট নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম আমরা সাজেকের রুপ গিলতে। সাজেকের রুইলুই পাড়ার হেড ম্যান লাল থাংগা লুসাই। রুইলুই পাড়া থেকে অল্প সময়ে পৌঁছে যাবেন সাজেক। সাজেকের বিজিবি ক্যাম্প বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিজিবি ক্যাম্প। এখানে হেলিপ্যাড আছে।

সাজেকের রুইলুই পাড়া থেকে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার ট্রেকিং করে দেখে আসতে পারেন সুন্দর কমলক ঝরনাটি। কমলক ঝরনাটি অনেকের কাছে পিদাম তৈসা ঝরনা অথবা সিকাম তৈসা ঝরনা নামেও পরিচিত।

সাজেকের শেষ গ্রাম কংলাক পাড়া যেটি সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ১৮০০ ফুট উচুতে অবস্থিত। এটি সাজেকের সর্বোচ্চ উচ্চতার। এটিও লুসাই জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পাড়া। এর হেড ম্যান চৌমিংথাই লুসাই। কংলাক পাড়া থেকে ভারতের লুসাই পাহাড় দেখা যায়। যেখান থেকে মূলত কর্ণফুলী নদী উৎপত্তি।

চারপাশে মনোরম পাহাড় সারি, সাদা তুলোর মতো মেঘের ভ্যালি আপনাকে মুগ্ধ করবেই। সাজেক এমনই আশ্চর্য্যজনক জায়গা যেখানে একই দিনে প্রকৃতির তিন রকম রূপের সান্নিধ্যে আপনি হতে পারেন চমৎকৃত।

কখনো বা খুব গরম অনুভূত হবে তারপর হয়তো হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে যাবেন কিংবা চোখের পলকেই মেঘের ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাবে আপনার চারপাশ। প্রাকৃতিক নিসর্গ আর তুলোর মত মেঘের পাহাড় থেকে পাহাড়ে উড়াউড়ির খেলা দেখতে সাজেক আদর্শ জায়গা।

শেষ বিকেল কাটাতে চলে গিয়েছিলাম আমরা কংলাক পাড়ায়। আর এই কংলাক পাড়া যে কংলাক পাহাড়ে অবস্থিত সেখান থেকে শেষ বিকেলে উপভোগ করা যায় সূর্য অস্ত যাওয়ার মনোমুগ্ধকর অসাধারণ দৃশ্য। অতঃপর আরেকটি দিনের সমাপ্তি।

এবার অপেক্ষা হাজার তারার আকাশের। রাতের ছিল বারবিকিউ এর আয়োজন যথারীতি বিসমিল্লাহ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে। তাদের এই আয়োজনও ছিল ভয়ংকর সুস্বাদু।

কোটি তারার আকাশ দেখতে হলে আপনাকে বের হতে হবে রাতের সাজেক দেখতে। দিন কিংবা রাত সাজেক যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো, সময় গড়ায় তবু সাজেকের সৌন্দর্য একটুও কমে না। সাজেকে গেলে অবশ্যই সকালে ভোরের সময়টা মিস করবেন না।

মেঘের খেলা আর সূর্যোদয়ের আলোর মেলা এই সময়েই বসে। এজন্য আপনাকে খুব ভোরে উঠে চলে যেতে হবে হ্যালিপ্যাডে, সেখান থেকেই সবচেয়ে সুন্দর সূর্যোদয় দেখা যায়। বিকেলের কোনো উঁচু জায়গা থেকে সূর্যাস্তের রঙ্গিন রূপ আপনাকে বিমোহিত করবেই।

আর সন্ধ্যার পর আকাশের কোটি কোটি তারার মেলা, আপনার প্রাণ জুড়িয়ে দিবে নিমিষেই। আকাশ পরিষার থাকলে দেখা পাবেন মিল্কিওয়ে বা ছায়াপথের। আর যদি দেখতে চান মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যেতে সেক্ষেত্রে সূর্য উদয়ের আগেই কিন্তু বেরিয়ে পরতে হবে।

সারা বছরই সাজেক ভ্রমণ করা যায় শুধু মাত্র ভরা বর্ষায় পাহাড়ি রাস্তায় ভ্রমণ না করাই উত্তম। রাস্তায় ধ্বস থানমে পারে, পাহাড়ি ধ্বস হতে পারে। তাই বর্ষার পরে শীতের শুরুর দিক পর্যন্ত সাজেক ভ্যালি ভ্রমণের আদর্শ সময়। এই সময় মেঘও পাওয়া যায় প্রচুর। গরমটা এড়িয়ে প্ল্যান করাটাই উত্তম।

এবার সাজেক থেকে ফেরার পালা, ফিরতে মন চাইবে না তবুও আমাদের ফিরতে হয়। সাজেক থেকে ফেরার পথে আবারো বিরতী দীঘিনালায়। এর এই সময় কিনে নিতে পারেন পাহাড়ি সবজি, স্বাদ নিতে পারেন টাটকা পাহাড়ি ফলের।

সাজেক থেকে ফিরেই ছুটলাম, খাগড়াছড়ি শহরের কাছেই পানখাই পাড়ায় ঐতিহ্যবাহী সিস্টেম রেস্তোরার দুপুরের লাঞ্চ করতে। তেঁতুলের কচি পাতা দিয়ে মুরগির স্যুপ, ফাল্গুনের কচি লালাভ আমপাতা ভর্তা কিংবা কাঁচা কচি আস্ত কলাগাছের ভর্তা!

কোনো আজগুবি গল্প নয়, এগুলো সত্যি খাবার। আর মজাদার এসব অদ্ভুত পাহাড়ি খাবার পেতে জুড়ি নেই পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির সমতল শহরের ঘরোয়া রেস্টুরেন্ট সিস্টেমের।

খাবারের বৈচিত্র্যে অন্য দুই পার্বত্য জেলা থেকে খাগড়াছড়ি যে আলাদা তার প্রমাণ মিলবে মং মারমার নিজ হাতে গড়া এ রেস্টুরেন্টে। পর্যটনের অপার সম্ভাবনার এ জেলায় এসে সিস্টেমে বাঁশ থেকে হাঁস খাননি- এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

জনা পঞ্চাশেক ভোজনরসিকের ধারণক্ষমতার এ রেস্টুরেন্টে সবচেয়ে বেশি ভিড় জমান সাজেকগামী পর্যটকরা। এখানে খেতে হলে রীতিমতো আগে থেকে বুকিং দিয়ে খেতে হয়। দুপুরের লাঞ্চ শেষ করেই এবার ছোটার পালা রিছাং ঝরনা পানে।

খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙা উপজেলার সাপমারা গ্রামে অপূর্ব সুন্দর রিসাং ঝরনার অবস্থান। স্থানীয়দের কাছে রিসাং ঝরনা ‘সাপ মারা রিসাং ঝরনা’ নামে পরিচিত। মারমা শব্দ রিছাং-এর অর্থ কোনো উঁচু স্থান হতে জলরাশি গড়িয়ে পড়া।

রিছাং ঝরনার অপর নাম তেরাং তৈকালাই। আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র হতে এই ঝর্ণার দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। আর খাগড়াছড়ি-ঢাকা সড়ক ধরে ১ কিলোমিটার এগিয়ে গিলেই রিসাং ঝরনা দেখতে পাওয়া যায়।

ভ্রমণকারীরা যেন সহজে ঝরনায় পৌঁছাতে পারেন সেজন্য এখানে পাকা সিঁড়িপথ তৈরি করা হয়েছে। প্রায় ৩০ মিটার উচ্চতার পাহাড় থেকে পানি আছড়ে পড়ার মনোরম দৃশ্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা উপভোগ করার মতো। আর চাইলে রিসাং ঝরনার জলে অনায়াসেই শরীর জুড়িয়ে নিতে পারবেন।

রিসাং ঝরনা দেখে আমরা ধরলাম আলু টিলা গুহার পথ। স্থানীয়দের কাছে আলুটিলা গুহা ‘মাতাই হাকড়’ বা ‘দেবতার গুহা’ নামে পরিচিত। আলুটিলা গুহার দৈর্ঘ্য ৩৫০ ফুট। গুহার ভেতরে সব সময় অন্ধকার থাকে এজন্য গুহায় প্রবেশ করতে হলে মশালের প্রয়োজন হয়।

চাইলে মশালের বিকল্প হিসেবে মোবাইল টর্চ বা চার্জ লাইট নিয়ে যেতে পারেন। তাছাড়া গুহার অভ্যন্তরের পাথরগুলো বেশ পিচ্ছিল তাই ভালো গ্রিপের জুতা পড়ে যাওয়া উচিত। আলুটিলা গুহায় প্রবেশের আগে মূল গেটের কাছ থেকে ৪০ টাকা দিয়ে টিকেট সংগ্রহ করতে হয়।

গুহার এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে অন্য প্রান্ত দিয়ে বের হতে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে। পাহাড়ের চূড়া থেকে ২৬৬টি সিঁড়ির নীচে আলুটিলা পাহাড়ের পাদদেশে পাথর আর শিলা মাটির ভাঁজে গড়া এ রহস্যময় সুড়ঙ্গ। গুহামুখের ব্যাস প্রায় ১৮ ফুট। আলুটিলা গুহা রিসাং ঝরনা থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত।

দেশবাসী দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে, এবার যে ঘরে ফেরার পালা। ফিরতে মন চাইবে না তবু আমাদের ফিরতে হয়। আর হ্যাঁ, প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কিছুই করবেন না দয়া করে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়