ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সুন্দরী জেলেকন্যা ও রহস্যময় গুহা: নারী ও রহস্যের গল্প

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

প্রকাশিত: ১৪:৪৫, ২ অক্টোবর ২০২২  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভ্রমণ যেমন উপভোগ্য হয়ে উঠছে; তেমনই ভ্রমণসাহিত্যও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রতিবছর বেশকিছু ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত হতে দেখা যায় বইমেলায়। বিক্রিও আশাব্যঞ্জক বলে দাবি করেছেন প্রকাশকরা। তারাও আগ্রহী ভ্রমণসাহিত্য প্রকাশ করতে। তবে মানসম্পন্ন পাণ্ডুলিপি পাওয়া কঠিন বলে মনে করেন তারা। এ ছাড়া দৈনিক বা ওয়েবগুলোতেও ভ্রমণকাহিনি চোখে পড়ে। তার পাঠকও আশাব্যাঞ্জক। কারণ যুগে যুগে কিছু ভ্রমণকাহিনি বিখ্যাত, জনপ্রিয় বা পাঠকপ্রিয়ও হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সমকালে পাঠকপ্রিয় ভ্রমণলেখক হয়ে উঠেছেন লেখক ও সাংবাদিক উদয় হাকিম।

উদয় হাকিম ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বর্ধনপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স পাস করে তিনি দৈনিক প্রথম আলো, আমার দেশ, কালের কণ্ঠ, চ্যানেল আই ও সিএসবি টিভিতে ১২ বছর সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি রাইজিংবিডি ডটকমের উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে ঢাকা বিজনেসের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

খেলাধুলা, ভ্রমণ এবং আবৃত্তি বিষয়ে উদয় হাকিমের আগ্রহ এবং অংশগ্রহণ রয়েছে। ইতোমধ্যেই তিনি ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখালেখি করছেন। ৭টি প্রকাশিত বইয়ের পাশাপাশি তার লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং ভ্রমণকাহিনি বিভিন্ন জাতীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

উদয় হাকিমের লেখা ভ্রমণকাহিনি প্রথম পড়ি অনলাইন পত্রিকায়। এরপর একে একে তিনটি বই হাতে আসে। এরমধ্যে একটি বই প্রকাশ হয় ২০১৭ সালে। বইটির নাম ‘সুন্দরী জেলেকন্যা ও রহস্যময় গুহা’। ভিয়েতনামের এক জেলেকন্যার উপকাহিনি স্থান পেয়েছে বইটিতে। এ ছাড়া ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার বালি ও মালদ্বীপের ওপর লেখা কয়েকটি ভ্রমণকাহিনি নিয়ে এ বই। বলতে গেলে সৌন্দর্যের সাবলীল বর্ণনা এটি। উদয় হাকিম গতানুগতিক ভ্রমণকাহিনি লিখতে চাননি। ভারী কথা আর ইতিহাস তুলে আনতে চাননি। তিনি গল্পের মতো করে কাহিনি বলার চেষ্টা করেছেন।

বইটিতে ১১টি শিরোনামে ভ্রমণের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে—
১. হ্যানয়, ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ
২. হ্যানয় থেকে হা লং বে
৩. হা লং বে: যেসব কারণে অনন্য
৪. ‘নয়নে আমার বিধি কেন পলক দিয়াছে’
৫. সুন্দরী জেলেকন্যা, রহস্যময় গুহা
৬. ভিয়েতনামযুদ্ধ এবং ভাস্কর্যকথন
৭. বালি এবং বাতাসের গল্প
৮. বিষ্ণু রাম সীতা—সাগর পাহাড়ের মিতা
৯. তানহা লট ও নুসা দুয়া
১০. লালচে বালি, ফেনিল ঢেউ
১১. মালদ্বীপে ২৪ ঘণ্টা।

শিরোনাম পড়েই অনুমান করা যায় ভেতরের ঐশ্বর্য সম্পর্কে। কারণ ঝরঝরে গদ্য লেখায় পারদর্শী উদয় হাকিম। তার ভ্রমণগদ্য পাঠককে আকৃষ্ট করেছে বরাবরই। লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ছবিও পাঠককে মুগ্ধ করে। বইটিতে ষাটটিরও বেশি ছবি স্থান পেয়েছে।

সাবলীল ভঙ্গিতে গল্প বলে যান উদয় হাকিম। কোনো রাখঢাক নেই। বাহুল্য নেই বর্ণণায়। নেই ঘটনার ঘনঘটা। লেখকের ভাষায়—‘ভিয়েতনাম যাচ্ছি। কুয়ালালামপুর হয়ে হ্যানয়। এরপর হ্যানয় থেকে হা লং বে। একটা কাগজ ছিল সঙ্গে। ভিয়েতনাম ইমিগ্রেশনের চিঠি। আমাদের চারজনের নাম, পাসপোর্ট নম্বর, সিল-ছাপ্পর ছিল। হ্যানয় গেলে ভিসা স্ট্যাম্পিং হবে। যথারীতি আটকে গেলাম। আবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে পার পেলাম।’

তার স্থানের বর্ণনা এমন—‘মালে’তে গাছপালা নেই বললেই চলে। এয়ারপোর্ট পুরোটা বৃক্ষহীন। হুলোমালে ঠিক বিপরীত। আছে নারকেল গাছ, রেইনট্রিসহ বড় বড় গাছ। সবুজ দ্বীপ। উত্তরপাশে কিছু জঙ্গলও আছে। পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে জায়গাটি। মালে অনেকটাই এলোমেলো। তার তুলনায় এই দ্বীপ সাজানো-গোছানো। দূর থেকেই আকর্ষণ করে। অভিজাত এলাকা। আমাদের দেশের গুলশান বনানীর মতো।’

উদয় হাকিমের লেখায় ইতিহাস, ভূগোল, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি উঠে আসে সাবলীলভাবে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে পাঠকের বুঝতে সহজ হবে। যেমন—
ইতিহাস: ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রয় ৬০ হাজার আমেরিকান সৈন্য মারা গেছে। পঙ্গু এবং আহত হয়েছে আরও সাড়ে তিন লাখ। যদিও ভিয়েতনামের লোক মারা গেছে প্রায় ২০ লাখ। (পৃষ্ঠা ৫৫)
ভূগোল: ভিয়েতনাম আমাদের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বড়। লোকসংখ্যা ৯ কোটি। (পৃষ্ঠা ১৩)
ঐতিহ্য: অনেকটা পথ হেঁটে মন্দিরের প্রবেশপথে পৌঁছি। সেখানে সবাইকে আলগা একখণ্ড কাপড় দেওয়া হয়। সেটা কোমরে পেঁচিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। (পৃষ্ঠা ৬৯)
সংস্কৃতি: শুরুতেই একদল লোক এসে গোল হয়ে বসে। ছা-ছা শব্দ করতে করতে তাদের প্রবেশ। বসেও কেবল ‘ছা ছা ছা ছা’ শব্দ করছে। এটা কেন? এটা হচ্ছে প্রাকৃতিক মিউজিক। (পৃষ্ঠা ৭৬)
অর্থনীতি: পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা দ্বীপ। এলাকা ভাগ করা। আবাসিক, হোটেল-রিসোর্ট, কমার্শিয়াল, শিল্প-কারখানা সবই আছে। (পৃষ্ঠা ১০০)
রাজনীতি: ১৯৭৮ সালে ক্ষমতায় আসেন মালদ্বীপের সবচেয়ে বেশি সময় রাজত্ব করা রাষ্ট্রপতি মামুন আব্দুল গাইয়ূম। নাসিরের সময় থেকেই রাজনৈতিক দলাদলি শুরু হয়। (পৃষ্ঠা ১০৯)

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বইটিতে এমন কোনো বিষয় নেই; যা উদয় হাকিম তুলে আনেননি। এই ভ্রমণকাহিনি পড়তে পড়তে পাঠক সব বিষয়ের স্পর্শ পাবেন। জানাশোনার পরিধি বাড়াতে পারবেন। কারও ঘুরতে যাওয়ার সাধ্য না থাকলেও বইগুলো পড়ে যেন কল্পনায় ঘুরে আসতে পারেন। যেমনটি আমি অনুভব করছি। পড়তে পড়তে আমিও ঘুরে এসেছি অনেক দেশ। পাঠক হিসেবে আমার সার্থকতা এখানেই। লেখক হিসেবেও সার্থক উদয় হাকিম।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়