ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৫ ১৪৩০

স্মৃতিগদ্য: শৈশবের শীতল দিনগুলো মনে পড়ে

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

প্রকাশিত: ১৪:৫৩, ৯ জানুয়ারি ২০২৩  

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

শীত বরাবরই আমার পছন্দের ঋতু। এর কয়েকটি কারণ হলো—ঘুমিয়ে আরাম, খাওয়ায় শান্তি, পোশাকে স্বস্তি, উৎসবের আমেজ। সমস্যাও কিছু আছে, যেমন—গোসলে কষ্ট, মাঝে মাঝে জনজীবন স্থবির। তবে শৈশবে সব ভাবনার উপরে উপভোগের বিষয়গুলোই প্রাধান্য পেত। বছর শেষে স্কুল বন্ধ থাকায় খালা, ফুফুদের বাড়ি বেড়াতে যেতাম। শীতের পিঠা-পায়েস, খেজুরের রস-গুড় লোভনীয় ছিল। 

আমার কাছে শীত মানে আলসেমি, শীত মানে কাঁপুনির ভয়। উঠোনে রোদ না দেখা পর্যন্ত কাঁথার নিচ থেকে বের হতাম না। মোটা মোটা দুই-তিনটি কাঁথা দিতেন মা। আমাদের লেপ বা কম্বল ছিল না। কাথা ঘরেই বানাতেন। শীতের আগে ছেঁড়া কাঁথাগুলো জোরাতালি দিয়ে ঠিক করতেন। কম্বল বা লেপ কেনার মতো টাকা হয়তো বাবার কাছে ছিল না। মায়ের পুরোনো-ছেঁড়া কাপড়, আমাদের পুরোনো-ছেঁড়া লুঙ্গি দিয়ে কাঁথা বানাতেন।

শৈশবে আমার আহামরি শীতের পোশাকও ছিল না।

মা কুশিকাটায় উল বুনে একটা জাম্পার বানিয়ে দিয়েছিলেন। কত বছর যে সেটা পরেছি, মনে করতে পারবো না। বেশি শীত হলে মায়ের একটি সবুজ রঙিন চাদর আমার গায়ে পেঁচিয়ে দিতেন। একবার প্যাঁচানো চাদর নিয়ে আগুন পোহাতে পড়ে গিয়েছিলাম রসের গরম তাফালের ওপর। সেই পোড়া দাগ এখনো ভ্রুতে বয়ে বেড়াচ্ছি। 

শীতে খুব বেশি কেডস পরতে পারিনি। তাই পা ঠান্ডা হয়ে থাকতো। নানার পুরোনো মোজা পরে ঘুরে বেরাতাম। একবার নানা প্লাস্টিকের কেডস বা জুতা কিনে দিলেন। সাদা রঙের সেই জুতা কত যত্ন করে পরতাম। ছিঁড়ে না যাওয়া পর্যন্ত পরেছি। শীতের সময় নিয়মিত পরতাম। গোসলের সময় সাবান দিয়ে ধুয়ে রাখতাম। যাতে ময়লা হয়ে না যায়।

আমার শৈশব নানি বাড়িতেই বেশি কেটেছে। শীতের সকাল কাটতো রোদ পোহাতে পোহাতে। কাচারি ঘরের সামনে মাচা তৈরি করে দিতেন নানা। সেখানে বসতেন গ্রামের সব ধরনের মানুষ। কাজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নানা রকম গল্প হতো। আমিও নানার একটি খয়েরি চাদর গায় দিয়ে বসে থাকতাম। রোদ পোহাতাম। কখনো কখনো স্কুলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ক্লাসের পড়া তৈরি করতাম।

নানার অনেকগুলো খেজুর গাছ ছিল। শিউলি নুরুল ইসলাম মামা গাছে হাঁড়ি দিতেন। রস ভাগ হতো অর্ধেক অর্ধেক। একদিন শিউলি মামা নিতেন। একদিন গাছের মালিক আমার নানা পেতেন। সপ্তাহে একদিন গাছে হাঁড়ি দেওয়া হতো না। শিউলি মামা গাছ থেকে হাঁড়ি নামালে আমরা ঝরা পাওয়ার জন্য ছোট হাঁড়ি দিতাম। বড় গাছ হলে এখলাসকে উঠতে হতো। আমার উঁচুতে ভয় ছিল। পা কাঁপতো।

খেজুর গুড়ের পাটালি দিয়ে ঘরে ভাজা মুড়ি খেয়ে সকাল শুরু হতো। যেদিন আমরা রস পেতাম, সেদিন নানি রসের নাস্তা রান্না করতেন। রসের নাস্তার মধ্যে মুড়ি দিয়ে খাওয়ার যে মজা, তা আজও লোভাতুর করে। রস বেশি হলে জাল দিতে দিতে পাতলা গুড় করতেন। পাতলা গুড় দিয়েও মুড়ি খাওয়া হতো। 

শীতে কষ্ট ছিল গোসল করার সময়। বিলের মাঝে খোলা পুকুরে দলবেঁধে যেতাম। রোদ উঠলে কিছুক্ষণ গা গরম করে নিতাম। কখনো কখনো দুষ্টুমি করে একজন আরেক জনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতাম। না হলে আরও কতক্ষণ যে বসে থাকবে, তার হিসেব নেই। যাকে ফেলে দেওয়া হতো, সে আবার পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিত অন্যদের। ফলে দ্রুত নেমে ঝপাঝপ দুটি ডুব দিয়েই কাঁপতে কাঁপতে উঠতে হতো। সেদিনকার মতো বেঁচে যাওয়া আর কি। 

শীতের শুরুর দিকে পুকুরের বা কুয়ার পানি কমে যেত। পুকুরে রাখা নানার নৌকা থেকে মাছ ধরতাম আমরা। ডুবিয়ে রাখা নৌকা তুলে পানি কমিয়ে নৌকার ভেতরে রাখা ডালপালা ফেলে দিয়ে পুটি, টেংরা, শিং, কই, টাকি, শোল, ফলি মাছ ধরা হতো। এছাড়া কুয়ার অবশিষ্ঠ পানি সেঁচে কাদার মধ্যে নেমে মাছ ধরা হতো। মাছ ধরায় এখলাস ও মকবুল ভালো পারদর্শী ছিল। মাঝে মাঝে শিং মাছের কাটা ফুটলে দৌড়ে উঠে যেতাম। তবে ওরা খুব কৌশলে কাদার ভেতর থেকে মাছগুলো তুলে আনতো। 

সবচেয়ে মজার বিষয় বেড়াতে যাওয়া। খালা বাড়ি গেলে খালাতো ভাই-বোন মিলে এক লেপের নিচে ঘুমাতাম। ফুফুদের বাড়িতেও সবাই মিলে এক বিছানায় জড়াজড়ি করে ঘুমাতাম। সকালে নানা রকমের পিঠা-পায়েস খেয়ে দিন শুরু হতো। বড় ফুফুর বাড়ি গেলে গোসল করতে যেতাম নদীতে। নদী বলতে তার হাঁটু পানি। ডুব দিলে অনেক সময় পিঠ জেগে থাকতো। রাজার চরে এখলাসদের বাড়ি গেলে খেজুর বাগানে যেতাম। নদীর পাড়ে ওদের বিশাল বাগান ছিল। সেখানে পাহারার জন্য একজন থাকতেন। আমরা গিয়ে গাছ থেকে হাঁড়ি নামিয়ে কাচা রস খেতাম। দিনভর রস জাল দিয়ে গুড় বানানো দেখতাম। এখলাসের বাবা ভালো গুড় বানাতে পারতেন।

মাঝে মাঝে রাতের বেলা খেজুর রস দিয়ে সেমাই খাওয়ার আয়োজন করা হতো। আমার বড়ভাই মোছলেহ উদ্দিন, মামাতো ভাই জাফর ঢালী, ফুফুাতো ভাই মোস্তাফিজুর রহমান, মুতাছিম বিল্লাহ ভাই তখন নানা বাড়ির কাচারি ঘরে থেকে পড়াশোনা করতেন। তারা বিকেল বেলা বাজার থেকে সেমাই কিনে আনতেন। রাতে শুরু হতো আমাদের রসদ সংগ্রহের অভিযান। মুতাছিম ভাই নানির মসলার পাত্র থেকে লবঙ্গ, দারচিনি, এলাচ চুরি করতেন। হাঁড়ি-ঢাকনা সংগ্রহ করতেন বড়ভাই। রস চুরি করতে বের হতেন জাফর ভাইকে নিয়ে। কারণ তার বাবাই ছিলেন শিউলি বা গাছি। পরিমাণমতো রস নিয়ে চুপি চুপি ফিরে আসতেন। কাচারি ঘরেই ইট দিয়ে অস্থায়ী চুলা বসিয়ে লাকড়ি ঘর থেকে আনা লাকড়ি দিয়ে রান্না হতো সেমাই। 

শীতের রাত অনেক বড়। গ্রামে তখন ভিসিআর ভাড়া করে আনা হতো। সাদা-কালো টিভিতে বারো ভোল্টেজের ব্যাটারি দিয়ে চালানো হতো। আমাদের গ্রামের আকন বাড়ি ও মাতুব্বর বাড়িতে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো। কারা কতবার আনতে পারে। তবে দেওয়ান বাড়ি, মাতুব্বর কান্দি, রাজদুলা কান্দি এবং শনিকোণায় আনা ভিসিআর দেখতে অনেক দূর থেকে লোক আসতো। তখন রাত জেগে আলমগীর, ফারুক, জসীম, ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না, সালমান শাহের সিনেমা দেখানো হতো। চাদর মুড়ি দিয়ে মুখ ঢেকে মুরুব্বিরাও বসতেন। যেন কেউ চিনতে না পারেন। অনেক সময় বাবা-ছেলে পাশাপাশি বসেও সিনেমা দেখতেন। কেউ কাউকে চিনতে পারতেন না। 

এ ছাড়াও আমার বিভিন্ন সময়ে শীতের সঙ্গী ছিলেন খালাতো ভাই মহিউদ্দিন, মোহসিন উদ্দিন, মামা মাহবুব ঢালী, রাকিব উদ্দিন, কাকা আমির সোহেল। তাদের সঙ্গ আমাকে বরাবরই আনন্দ দিতো। একসঙ্গে ঘুমানো, সিনেমা দেখা, ঘুরতে যাওয়া এখন খুব মিস করছি। কী দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছি তখন। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি অনেক দূরে। বাড়ি ফেরার কথা মনেই পড়েনি। তবে রাতে ভয় পাওয়া রাকিবকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হতো। সাহসী হিসেবে মহিউদ্দিন ভাই ছিলেন আমার অনুপ্রেরণা। মোহসিন বয়সে বড় হলেও ছিল আমার গল্পের বন্ধু। 

শৈশবের শীতের এত স্মৃতি বিস্তারিত লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে। খণ্ড খণ্ড সেইসব স্মৃতি আজও তাড়িত করে। জীবিকার তাড়নায় আজ আমরা কে কোথায়, সে খবরও হয়তো অনেকের জানা নেই। আমাদের সেই শৈশবের আনন্দ এখন আর চোখে পড়ে না। এ যুগের ছেলে-মেয়েরা লেপের নিচে শুয়ে বড়জোর সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন, ‘বাইরে বড্ড শীত, আমি কম্বলের নিচে।’ আমি এখনো আবেগ তাড়িত হই। সেসব দিনের কথা ভেবে শীতকে খুব অনুভব করি। শহরের কংক্রিটের দেওয়ালের মাঝেও চোখ বন্ধ করে চলে যাই শৈশবের সেইসব শীতল দিনগুলোতে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়