ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

‘হামার মরণ হয়, জীবনের মরণ যে নাই’

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:১৯, ২৮ ডিসেম্বর ২০২২  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় যখন শকুনি নেমে আসে এই সোনার বাংলায়, নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় যখন এ দেশ ছেয়ে যায় দালালের আলখাল্লায়, নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়, নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়,’

শীতের কোনো এক সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে বসে শুনেছিলাম। কনকনে শীতে কাঁপতে কাঁপতে কোনো এক আবৃত্তি শিল্পীর ভরাট গলা বলতে ছিল ‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/ যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়।’ তখনও জানতাম না এই কবিতার লেখক কে। কে এতটা সাবলীল ভাষায় নিজের আঞ্চলিকতা ধরে কবিতা লিখেছেন এবং ‘নূরল’কে সময়ের কণ্ঠ তৈরি করেছেন। খুঁজতে শুরু করলাম লেখক কে বা ‘নূরলদীন’ কে? এটি লেখকের মনগড়া চরিত্র ছিল, নাকি যার দিনের কথা বলা হয়েছে সে এই বঙ্গের সাধারণ জনতায় নায়ক ছিল!

লেখককে পেয়ে গেলাম দ্রুত। তিনি বিংশ শতাব্দীর শেষাভাগে সক্রিয় একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি সাহিত্যিক। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, অনুবাদ তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণা ছিল তার। এই জন্য বলাহয় তাকে ‘সব্যসাচী লেখক’। যার লেখকজীবন প্রায় ৬২ বছরব্যাপী বিস্তৃত। এমনকি মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তিনি অন্য কেউ নন সৈয়দ শামসুল হক।

এই তো গেল লেখকে পাওয়া। এবার চরিত্রের খোঁজ। একটু খোঁজা-খুঁজি করে পড়া-লেখা করে তাকেও পেয়ে গেলাম। তার পরিচয়টি একটু জানি, প্রায় আড়াইশো বছর আগের ঘটনা। ইংরেজদের শোষণ এবং লুণ্ঠনের সহযোগী এবং গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর প্রিয়পাত্র দেবী সিংহের ভয়াবহ অত্যাচার এবং নির্যাতনে রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চল মৃতপ্রায়।

দেবী সিংহ ছিলেন ইংরেজ মনোনীত এই অঞ্চলের ইজারাদার। কিন্তু, তার সীমাহীন লোভ লণ্ড-ভণ্ড করে দিয়েছিল এই জনপদকে। শুধু এই অঞ্চলে নয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা ও বিহারের দেওয়ানী লাভের পর সমগ্র বাংলাদেশ ও বিহারে যে অবর্ণনীয় অরাজকতা দেখা দিয়েছিল, তার প্রধান কারণ ছিল দেবী সিংহের লুণ্ঠন ও উৎপীড়ন। তার অপরিসীম অত্যাচার ও অন্তহীন অবাধ লুণ্ঠনে রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চল পরিণত হয়েছিল শ্মশানে। চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছিল অসহায় কৃষকদের হাহাকার আর গগনভেদী দীর্ঘশ্বাস।

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অসহায় হরিণও ঘুরে দাঁড়ায়, এই অঞ্চলের নিরীহ এবং নির্বিবাদী কৃষকেরাও তেমনি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। এমনিতেই মৃত্যু হচ্ছে মহামারীর মতো, কাজেই মৃত্যুকে নিয়ে তাদের আর কোনো ভয় ডর ছিল না। বরং পরম পরাক্রমশালী দেবী সিংহ এবং সীমাহীন শৌর্যবান ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিপুল বিক্রমে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তারা।

খনির ঘন অন্ধকার থেকে যেমন করে উঠে আসে উজ্জ্বল হীরকখণ্ড, তেমনি সাধারণ কৃষকদের মধ্য থেকে উঠে আসেন এক অসামান্য মানুষ, একজন অমিতবিক্রমশালী সিংহ-হৃদয় পুরুষ। নিপীড়িত জনগণকে সংঘবদ্ধ করে দেবী সিংহের বিরুদ্ধে প্রবল তেজে রুখে দাঁড়ান তিনি।

সেটি সতেরো-শো তিরাশি সাল। এ বছরই এই অনন্য মানুষটি দেবী সিংহকে করে তোলেন নেংটি ইঁদুরের মতো ভীত এবং অসহায়। ইতর প্রাণির মতো প্রাণভয়ে পলাতক হন দেবী সিংহ আর এই মুক্তিকামী মানুষটি কাঁপিয়ে দেন বাংলার বুকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে। একের পর এক যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বিপর্যস্ত করে তোলেন তাদের। তবে, শেষ রক্ষা হয় না। এরকমই এক যুদ্ধে আহত হয়ে বন্দি হন তিনি। তারপর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বন্দি দশায় মৃত্যু ঘটে তার। কৃষকদের এই সর্বব্যাপী সশস্ত্র বিদ্রোহই রংপুর বিদ্রোহ নামে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে।

আর এই বিদ্রোহের যিনি নায়ক, যিনি জনগণের জন্য আত্মত্যাগ করেছেন, তার নাম নূরুলউদ্দীন। ঠিক ধরেছেন বলছি ফকির বিদ্রোহের পটভূমির কথা।

লেখক সময়ের অবস্থান দেখে বারবার তাকে স্মরণ করেছেন। ‘যখন শকুনি নেমে আসে এই সোনার বাংলায়/ নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’। শকুনের কালো ডানা এই বাংলার আকাশ ঘিরে রেখেছে। তার ক্ষুধা লাগলেই সে ঠোকর দিয়েই খাদ্য গ্রহণ করে। সে খাদ্য এদেশেরই এক শ্রেণির দালাল আছে তারা সরবরাহ করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলা যায় না। মুখ খুললেই শকুনের খাদ্য।

‘নূরলদীনের সারাজীবন’ লেখকের পরিচয় বহন করে। কেন তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন তাও বুঝা যায়। যেকোনো বিবেচনায় এটি বাংলা কাব্যনাট্য ধারায় একটি অনন্য সংযোজন। এই রচনায় লেখকের পরিশ্রম ও মেধা সন্দেহাতীতভাবে লক্ষ্য করা যায়। আজ সৈয়দ শামসুল হকের ৮৩তম জন্মদিন। তিনি ১৯৩৫ সালের এ দিনে কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন লেখক ও চিকিৎসক।

সৈয়দ শামসুল হকের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’, ‘পরানের গহীন ভিতর’, ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’, ‘নীল দংশন’, ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘নিষদ্ধি লোবান’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’সহ প্রভৃতি।

এই সব্যসাচী লেখ যেমন মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন তেমনি পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরষ্কারও। পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা ও স্বীকৃতি।

বাংলা সাহিত্যের এই প্রখ্যাত লেখক ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়