ঢাকা, মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

কোরআন পরিচিতি ও নাজিলের ইতিহাস (পর্ব-২)

গাজী মো. রুম্মান ওয়াহেদ

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা হজরত জীবরাঈল (আ.) এর কর্তৃক মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে প্রথমে পবিত্র হেরা গুহায় কোরআন শরিফ নাজিল করেছিলেন। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থের নাম আল কোরআন।

কোরআনের প্রথম ওহী ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন।’(সূরা আলাক ১-৫) এবং কোরআনের সর্বশেষ ওহী ‘সে দিনকে ভয় করো যেই দিন তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে নেওয়া হবে ।’(সূরা আল বাকারা ২৮১)

কোরআনে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের মোট ১১৪টি সূরা রয়েছে। সব সূরা মিলিয়ে মোট আয়াতের (আয়াত আরবি শব্দ, এর সাহিত্যিক অর্থ নিদর্শন) সংখ্যা প্রায় ৬,২৩৬ (মতান্তরে ৬৩৪৮টি অথবা ৬৬৬৬টি)। প্রত্যেকটি সূরার একটি নাম রয়েছে। নামকরণ বিভিন্ন উপায়ে করা হয়েছে; তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সূরার অভ্যন্তরে ব্যবহৃত কোনো শব্দকেই নাম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।

এছাড়া এমন নামও পাওয়া যায় যা সূরার অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হয় নি যেমন- সূরা ফাতিহা। ফাতিহা শব্দটি এ সূরার কোথাও নেই। সূরাগুলোর একটি সুনির্দিষ্ট সজ্জা রয়েছে। সজ্জাকরণ তাদের অবতরণের ধারাবাহিকতা অনুসারে করা হয় নি। বরং দেখা যায় অনেকটা বড় থেকে ছোট সূরা অনুযায়ী সাজানো। অবশ্য একথাও পুরোপুরি সঠিক নয়। সজ্জার প্রকৃত কারণ কারো জানা নেই। অনেক ক্ষেত্রে বড় সূরাও ছোট সূরার পরে এসেছে। তবে একটি সূরা বা তার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ধারাবাহিকতার সাথেই অবতীর্ণ হয়েছিল বলে মুসলমানদের ধারণা। কোরআনের সজ্জাটি মানুষের মুখস্থকরণের সুবিধার সৃষ্টি করেছে।

হিজ্‌ব বা মানজিল হচ্ছে কোরআনের প্রথম সূরা (সূরা ফাতিহা) ব্যতীত অন্য সূরাগুলো নিয়ে করা একটি শ্রেণি। হিজ্‌ব মুফাস্‌সিল একটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করা। এতে ৭টি মানজিলের মাধ্যমে সবগুলো সূরাকে একসঙ্গে করা হয়েছে।

কোরআনের মানজিলগুলো হচ্ছে-

মানজিল ১ = ৩টি সূরা, যথা, ২-৪
মানজিল ২ = ৫টি সূরা, যথা, ৫-৯
মানজিল ৩ = ৭টি সূরা, যথা, ১০-১৬
মানজিল ৪ = ৯টি সূরা, যথা, ১৭-২৫
মানজিল ৫ = ১১টি সূরা, যথা, ২৬-৩৬
মানজিল ৬ = ১৩টি সূরা, যথা, ৩৭-৪৯
মানজিল ৭ = ৬৫টি সূরা, যথা, ৫০-১১৪

কোরআনে মোট ৩০টি পারা বা অধ্যায় রয়েছে। ১১৪টি পূর্নাঙ্গ সূরা রয়েছে। সূরাগুলো বিভিন্ন আকারের হলেও কোরআনের পারাগুলো প্রায় সমান আকারের। কোরআন মুখস্থকরণের ক্ষেত্রে সাধারণতম পারা অনুযায়ী শিক্ষা করানো হয়। যেসব স্থানে সমগ্র কোরআন পাঠের আয়োজন করা হয় সেখানেও এই পারা অনুযায়ী করা হয়।

সূরাগুলো নাম ও অর্থ 

১. আল ফাতিহা (সূচনা) ২. আল বাকারা (বকনা-বাছুর) ৩. আল ইমরান (ইমরানের পরিবার) ৪. আন নিসা (নারী) ৫. আল মায়িদাহ (খাদ্য পরিবেশিত টেবিল) ৬. আল আনআম (গৃহপালিত পশু) ৭. আল আরাফ (উচু স্থানসমূহ) ৮. আল আনফাল (যুদ্ধে-লব্ধ ধনসম্পদ) ৯. আত তাওবাহ্ (অনুশোচনা) ১০. ইউনুস (নবী ইউনুস) ১১. হুদ (নবী হুদ) ১২. ইউসুফ (নবী ইউসুফ) ১৩. আর রা’দ (বজ্রপাত) ১৪. ইব্রাহীম (নবী ইব্রাহিম) ১৫. আল হিজর (পাথুরে পাহাড়) ১৬. আন নাহল (মৌমাছি) ১৭. বনী-ইসরাঈল (ইহুদী জাতি) ১৮. আল কাহফ (গুহা) ১৯. মারইয়াম (মারইয়াম (ঈসা নবীর মা) ২০. ত্বোয়া-হা (ত্বোয়া-হা) ২১. আল আম্বিয়া (নবীগণ) ২২. আল হাজ্জ্ব (হজ্জ) ২৩. আল মু’মিনূন (মুমিনগণ) ২৪. আন নূর (আলো) ২৫. আল ফুরকান (সত্য মিথ্যার পার্থক্য নির্ধারণকারী গ্রন্থ) ২৬. আশ শুআরা (কবিগণ) ২৭. আন নম্ল (পিপীলিকা) ২৮. আল কাসাস (কাহিনী) ২৯. আল আনকাবূত (মাকড়শা) ৩০. আর রুম (রোমান জাতি) ৩১. লোক্মান (একজন জ্ঞানী ব্যাক্তি) ৩২. আস সেজদাহ্ (সিজদা) ৩৩. আল আহ্যাব (জোট) ৩৪. সাবা (রানী সাবা/শেবা) ৩৫. ফাতির (আদি স্রষ্টা) ৩৬. ইয়াসীন (ইয়াসীন) ৩৭. আস ছাফ্ফাত (সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো) ৩৮. ছোয়াদ (আরবি বর্ণ) ৩৯. আয্-যুমার (দলবদ্ধ জনতা) ৪০. আল মু’মিন (বিশ্বাসী) ৪১. হা-মীম সেজদাহ্ (সুস্পষ্ট বিবরণ) ৪২. আশ্-শূরা (পরামর্শ) ৪৩. আয্-যুখরুফ (সোনাদানা) ৪৪. আদ-দোখান (ধোঁয়া) ৪৫. আল জাসিয়াহ (নতজানু) ৪৬. আল আহ্ক্বাফ (বালুর পাহাড়) ৪৭. মুহাম্মদ (নবী মুহাম্মদ) ৪৮. আল ফাৎহ (বিজয়, মক্কা বিজয়), ৪৯. আল হুজুরাত (বাসগৃহসমুহ), ৫০. ক্বাফ (ক্বাফ), ৫১. আয-যারিয়াত (বিক্ষেপকারী বাতাস), ৫২. আত্ব তূর (পাহাড়), ৫৩. আন-নাজম (তারা), ৫৪. আল ক্বামার (চন্দ্র) ৫৫. আর রাহমান (পরম করুণাময়) ৫৬. আল ওয়াক্বিয়াহ্ (নিশ্চিত ঘটনা) ৫৭. আল হাদীদ (লোহা) ৫৮. আল মুজাদালাহ্ (অনুযোগকারিণী), ৫৯. আল হাশ্র (সমাবেশ), ৬০. আল মুম্তাহিনাহ্ (নারী, যাকে পরীক্ষা করা হবে), ৬১. আস সাফ (সারবন্দী সৈন্যদল), ৬২. আল জুমুআহ (সম্মেলন/শুক্রবার), ৬৩. আল মুনাফিকূন (কপট বিশ্বাসীগণ), ৬৪. আত তাগাবুন (মোহ অপসারণ),৬৫. আত ত্বালাক (তালাক), ৬৬. আত তাহ্রীম (নিষিদ্ধকরণ), ৬৭. আল মুল্ক (সার্বভৌম কতৃত্ব, ৬৮. আল ক্বলম (কলম), ৬৯. আল হাক্কাহ (নিশ্চিত সত্য), ৭০. আল মাআরিজ (উন্নয়নের সোপান), ৭১. নূহ (নবী নূহ) ৭২. আল জ্বিন (জ্বিন সম্প্রদায়) ৭৩. আল মুয্যাম্মিল (বস্ত্রাচ্ছাদনকারী) ৭৪. আল মুদ্দাস্সির (পোশাক পরিহিত), ৭৫. আল ক্বিয়ামাহ্ (পুনর্ত্তুান), ৭৬. আদ দাহ্র (মানুষ), ৭৭. আল মুরসালাত (প্রেরিত পুরুষগণ), ৭৮. আন্ নাবা (মহাসংবাদ), ৭৯. আন নাযিয়াত (প্রচেষ্টাকারী), ৮০. আবাসা (তিনি ভ্রুকুটি করলেন) ৮১. আত তাক্ভীর (অন্ধকারাচ্ছন্ন), ৮২. আল ইন্ফিতার (বিদীর্ণ করা), ৮৩. আত মুত্বাফ্ফিফীন (প্রতারণা করা), ৮৪. আল ইন্শিকাক (খন্ড-বিখন্ড করণ), ৮৫. আল বুরুজ (নক্ষত্রপুন্জ), ৮৬. আত তারিক্ব (রাতের আগন্তুক), ৮৭. আল আ’লা (সর্বোন্নত), ৮৮. আল গাশিয়াহ্ (বিহ্বলকর ঘটনা), ৮৯. আল ফাজ্র (ভোরবেলা), ৯০. আল বালাদ (নগর), ৯১. আশ শামস (সূর্য), ৯২. আল লাইল (রাত্রি), ৯৩. আদ দুহা (পূর্বান্হের সুর্যকিরণ) ৯৪. আল ইনশিরাহ (বক্ষ প্রশস্থকরণ), ৯৫. আত ত্বীন (ডুমুর), ৯৬. আল আলাক (রক্তপিন্ড), ৯৭. আল ক্বাদর (মহিমান্বিত), ৯৮. আল বাইয়্যিনাহ (সুস্পষ্ট প্রমাণ) ৯৯. আল যিল্যাল (ভূমিকম্প), ১০০. আল আদিয়াত (অভিযানকারী) ১০১. আল ক্বারিয়াহ (মহাসংকট) ১০২. আত তাকাসুর (প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা) ১০৩. আল আছর (সময়), ১০৪. আল হুমাযাহ (পরনিন্দাকারী), ১০৫. আল ফীল (হাতি), ১০৬. কুরাইশ (কুরাইশ গোত্র), ১০৭. আল মাউন (সাহায্য-সহায়তা), ১০৮. আল কাওসার (প্রাচুর্য), ১০৯. আল কাফিরুন (অবিশ্বাসী গোষ্ঠী), ১১০. আন নাসর (স্বর্গীয় সাহায্য), ১১১. আল লাহাব (জ্বলন্ত অংগার), ১১২. আল ইখলাস (একত্ব) ১১৩. আল ফালাক (নিশিভোর) ১১৪. আন নাস (মানবজাতি)।

কোরআনের বিষয়বস্তু আল্লাহর অস্তিত্ব এবং পুনরুত্থানসহ মৌলিক ইসলামি বিশ্বাসসমূহ বর্ণনা করে। পূর্বের নবীগণের বিবরণ, নৈতিক ও আইনগত বিষয়, মুহাম্মাদের (সা.) সময়ের ঐতিহাসিক ঘটনা, দানশীলতা ও নামাজের কাহিনিও কোরআনে বর্ণিত হয়েছে।

কোরআনের আয়াতে ঠিক-বেঠিক সম্পর্কে সাধারণ উপদেশ রয়েছে এবং এতে বর্ণিত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো সাধারণ নৈতিক পাঠের রূপরেখা প্রদান করে। প্রাকৃতিক ঘটনা সম্পর্কিত আয়াতগুলোকে মুসলিমরা কোরআন এর বার্তার সত্যতার ইঙ্গিত হিসেবে ব্যাখ্যা করে।

কোরআনের কেন্দ্রীয় ধারণা হলো একেশ্বরবাদ। আল্লাহ জীবন্ত, শাশ্বত, সর্বব্যাপী এবং সর্বশক্তিমান হিসেবে বর্ণিত। আল্লাহর শক্তিমত্তা তার সৃষ্টির ক্ষমতায় সর্বোপরি আবির্ভূত হয়। তিনি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর স্রষ্টা।

কোরআন এর মতে আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরতার দিক দিয়ে সব মানুষ সমান এবং এই সত্যকে স্বীকার করা ও তদনুযায়ী জীবন পরিচালনার মধ্যেই মানুষের কল্যাণ নিহিত।

কোরআনে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য বিভিন্ন আয়াতে সৃষ্টিতাত্ত্বিক যুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ,মহাবিশ্ব প্রবর্তিত হয়েছে সুতরাং এর একজন প্রবর্তক প্রয়োজন এবং যা কিছু বিদ্যমান, সবকিছুর অস্তিত্বের জন্যই একটি যথার্থ কারণ থাকতে হবে। এছাড়া, এক্ষেত্রে মহাবিশ্বের কথাও প্রায়ই উল্লেখ করা হয়েছে:

الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا ۖ مَّا تَرَىٰ فِي خَلْقِ الرَّحْمَـٰنِ مِن تَفَاوُتٍ ۖ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَىٰ مِن فُطُورٍ

অর্থ: ‘তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিতে কোকো তফাত দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টিফেরাও; কোনো ফাটল দেখতে পাও কি?’ (সূরা আল মুলক, আয়াত: ৩)।

কোরআনে উল্লেখিত নবী-রাসূলগণ-

(১) আদম

(২) শিষ

(৩) ইদ্রিস

(৪) নূহ

(৫) ইব্রাহিম

(৬) ইসমাইল

(৭) ইসহাক

(৮) শোয়াইব

(৯) ইয়াকুব

(১০) ইউসুফ

(১১) ইমরান

(১২) জাকারিয়া

(১৩) ইয়াহিয়া

(১৪) মুসা

(১৫) হারুন

(১৬) দাউদ

(১৭) সোলাইমান

(১৮) লোকমান

(১৯) লুত

(২০) হুদ

(২১) সালেহ

(২২) ইউনুস

(২৩) ইলিয়াস

(২৪) আইয়্যুব

(২৫) মুহাম্মদ

কোরআনে বিষয়ভিত্তিক আয়াত

জান্নাতের ওয়াদা ১০০০, জাহান্নামের ভয় ১০০০, নিষেধ ১০০০, আদেশ ১০০০, উদাহারণ ১০০০, কাহিনি ১০০০, হারাম ২৫০, হালাল ২৫০, আল্লাহর পবিত্রতা ১০০, বিবিধ ৬৬।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়