ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৮ ১৪৩১

ঈদ অর্থনীতি

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:২২, ৭ এপ্রিল ২০২৪  

ঈদ অর্থনীতি

ঈদ অর্থনীতি

বছর ঘুরে আবার এলো ঈদ আনন্দের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। যা ছড়িয়ে পড়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের মাঝে। এ আনন্দের মূল উপজীব্য হলো পোশাক। নতুন সাজ-পোশাকে বাধাহীন ছুটে চলায় থাকে ঈদের আনন্দ। প্রিয় মানুষগুলোকে বিভিন্ন উপহার দেওয়ায় পাওয়া যায় নির্মল ভালোলাগা। ঈদের আগ মুহূর্তে প্রায় মাসখানেক লোকারণ্য থাকে ছোট-বড় সব মার্কেট। তাই ঈদকে কেন্দ্র করে অন্যান্য সময়ের তুলনায় অর্থপ্রবাহ বাড়ে বহুগুণ। চাঙ্গা হয় পর্যটন শিল্প, ই-কমার্স এবং রেমিটেন্সসহ সকল অর্থনৈতিক খাত।

রমরমা পোশাকের বিপণিবিতান : ঈদ আনন্দের অবিচ্ছেদ্য অংশ নতুন পোশাক। এ কারণে রমজানের শুরু থেকেই বিপণিবিতানে থাকে কেনাকাটার ধুম। প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের একটি পোশাক হলেও চলে কিন্তু শিশু থেকে কিশোর-কিশোরী একাধিক ড্রেস না হলে মহামুশকিল। তাদের আবদার মেটাতে অভিভাবকরা ছুটে চলে ছোট থেকে বড় বিভিন্ন মার্কেটে। ফুটপাত থেকে মোড়ের অলিতে-গলিতে সকল বিপণিবিতানে গভীর রাত পর্যন্ত শোনা যায় ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক। শুক্রবার রাত ১১টার সময়ে গাউছিয়া মার্কেটে নেমে মনে হচ্ছিল সবেমাত্র সন্ধ্যা হলো।

পথচারীদের হাতে একাধিক শপিং ব্যাগ। রাস্তাজুড়ে রিকশা আর লোকজনের আনাগোনা। প্রায় দুই ঘণ্টা কেনাকাটা করলাম। তখনও মার্কেটের চিত্র একদমই পাল্টায়নি। একজন বিক্রেতা বলল সেহরির আগ পর্যন্ত এমনই থাকে। এরপর সকাল ৯টা পর্যন্ত ক্রেতা তেমন দেখা যায় না। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার লোকজন আসা শুরু করে। এবার গতবারের চেয়ে ভালো বেচাকেনা হচ্ছে বলে জানালেন। তবে দিনের তুলনায় রাতের তাপমাত্রা কম থাকায় সন্ধ্যার পর থেকেই বাড়তে থাকে ক্রেতার চাপ।এ বছর ঈদকে কেন্দ্র করে দেশে আড়াই লাখ কোটি টাকার কেনাবেচার প্রত্যাশা করছে ব্যবসায়ীরা। ডলার সংকট এবং বৈশ্বিক পণ্য বর্জনের মতো নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও এবার ভালো ব্যবসা করছেন বলে জানালেন ব্যবসায়িরা। গত বছরের চেয়ে পণ্যের দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে, তাই বাজেট নিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়ছে নি¤œ ও মধ্যবিত্তরা। এফবিসিসিআই এর পরিচালক ও ঢাকা মহানগরী দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হেলাল হাফিজ বলেছেন, দেশে কোটিপতি রয়েছে ১ লাখ সাড়ে ১৩ হাজার।এরা যদি দেশেই শপিং করতেন, তবে আর্থিক লেনদেন আরও অনেক বেড়ে যেত। কিন্তু এরা অনেকেই কেনাকাটা করতে চলে যান দেশের বাইরে। আশার খবর হলো, অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এবার ঈদ অর্থনীতি পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি গতিশীল।  
পরিবহন খাত চাঙ্গা : সারা বছর পরিবহন খাত একই সরলরেখায় চললেও ঈদ উৎসবে দেখা যায় ভিন্নমাত্রা। বাসের টিকিট, ট্রেনের টিকিট, প্লেনের টিকিট, লঞ্চের কেবিন সব বুকিং হয়ে যায় ঈদের পনেরো দিন আগেই।অনেক ঝক্কিঝামেলার পরও সবাই ছুটে চলছেন শেকড়ের টানে। তথ্যমতে, রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরটি ঈদের সময়ে প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। কেউ যায় দেশের বাড়িতে আবার কেউ ছুটি কাটাতে বিদেশে পাড়ি জমায়। উচ্চবিত্তরা দেশের বাইরে গেলেও মধ্যবিত্তরা ছুটে যান বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। এজন্য দেশের পর্যটন শিল্পও এ সময়ে হয় যথেষ্ট লাভবান। 

রেমিটেন্সে ঊর্ধ্বগতি : প্রিয় মানুষদের ঈদ আরও উৎসবমুখর করতে প্রবাসীরা এ সময়ে বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠান। অর্থনীতিতে যোগ হয় প্রায় এক কোটি প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত মাসের (মার্চ) ২৯ দিনে বৈধপথে ১৮১ কোটি ৫১ ডলারের রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ (প্রতি এক ডলার সমান ১১০ টাকা ধরে) প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা (১৯ হাজার ৯৬৬ কোটি)।

দৈনিক গড়ে আসছে ৬ কোটি ২৫ লাখ ডলার বা ৬৮৮ কোটি টাকার বেশি। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১০ কোটি বা ২ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স এসেছিল এবং দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে এসেছিল ২১৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। চলতি মাসে রেমিটেন্স আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়। সাধারণত রোজা, ঈদ, বাংলা নববর্ষকে ঘিরে প্রবাসীরা অন্য সময়ের চেয়ে বেশি অর্থ দেশে পাঠিয়ে থাকেন। এবারও তেমনটিই হয়েছে। বিদেশের মাটিতে ঘাম ঝরিয়ে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠান প্রবাসী শ্রমিকরা, যা আমাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। আর মুসলমানদের প্রধান দুটো উৎসবে এই রেমিটেন্স বাড়ে কয়েকগুণ।
ই-কমার্স ও এফ কমার্স : এবারের ঈদ কেনাকাটায় ই- কমার্স  এবং এফ কমার্স বেশ প্রভাব ফেলছে। জানা যায়, মোট বেচাকেনার ২৫ শতাংশই হচ্ছে ই-কমার্সে। ফেসবুকভিত্তিক এফ কমার্সও দখল করেছে বড় একটি বাজার। ফলে মার্কেটে অনেক চাপ কমেছে বলে মনে করছেন অনেক ব্যবসায়ী। বৈশ্বিক মহামারি করোনার পর থেকেই ই-কমার্সের বাজার বেড়ে যায় দ্রুত। কেননা ঘরবন্দি মানুষের জীবনের প্রয়োজন মেটাতে ই-কমার্সই ছিল একমাত্র ভরসা। সে সময় এই খাতে আর্থিক লেনদেন বাড়ে বহুগুণ।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত রমজানের শুরু থেকে অনলাইনে বিক্রি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বাড়ে। দেশে ই-কমার্স সাইট আছে অন্তত তিন হাজার। এবার পণ্য ডেলিভারি প্রায় ৯ লাখে পৌঁছাতে পারে। মানুষের কর্মব্যস্ততা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। অনেকেরই সময় হয় না মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করার। আবার অনেকে ভিড় ঠেলে বা দরকষাকষি করে শপিং করা পছন্দ করেন না। তারা প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে ফেলছেন ই-কমার্স প্লাটফর্ম থেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ফ্যাশন হাউসগুলোর ওয়েবসাউট থেকেও হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্ডার ও ডেলিভারি।  
বাড়ে শৌখিন পণ্যের কেনাকাটা : প্রতিবছরই উৎসব ভাতার মাধ্যমে অর্থনীতিতে যোগ হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। সরকারি সাড়ে ১২ লাখ এবং বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরও প্রায় দেড় কোটি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাসে বাড়ে আর্থিক লেনদেন। ঈদের সময়ে পোশাকের পাশাপাশি বাড়ে প্রসাধনী, মোবাইল ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের বিক্রি। রমজানের প্রথম ২০ দিন পোশাকের বাজার জমজমাট থাকলেও পরবর্তীতে এর সঙ্গে ম্যাচিং জুতা, ঘড়ি, ব্যাগ এবং প্রসাধনী বেচাকেনা বাড়ে।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, এপেক্স, বাটা, বে, ওরিয়ন, লোটো বিভিন্ন বড় ব্যান্ডে উচ্চবিত্তরা ভিড় করছে। নি¤œবিত্তরা দেশীয় জুতা-স্যান্ডেলেই বেশ সন্তুষ্ট। ব্র্যান্ডের জুতার দাম প্রায় ৬০০ থেকে ১৭ হাজারের মধ্যে। বছরের অন্যান্য সময়ে এসব পণ্যের কেনাকাটা ঢিলেঢালাভাবে চললেও ঈদে বাড়ে বিপুল পরিমাণে। অনেক ক্রেতারা সৌখিন পণ্যের সারা বছরের কেনাকাটা ঈদের সময়ে করেন। তাই বাড়তি বিনিয়োগ লক্ষ্য করা যায় ঈদ অর্থনীতিতে।   
জাকাত ও ফিতরা : বাসায় প্রতিদিন একজন নারী আসেন গৃহকাজে সহায়তা করতে। আজ বললেন তিনি এবার বোনাস পেয়েছেন প্রায় ৩০ হাজার টাকা মাত্র ৬টি বাসা থেকে। পাশাপাশি পেয়েছেন ঈদের কাপড় এবং নিয়মিত বেতন। কি করবেন জিজ্ঞেস করলে বলল অনেক ঋণ আছে, তা শোধ করব এবং বাড়িতে যাব। সমাজের অধিকাংশ বিত্তবানরা ঊৎসবকালীন অর্থ বিতরণ করেন গরিবের মাঝে। তবে বিতরণকৃত অর্থ সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রদান করলে অনেক পরিবার মুক্ত হতে পারত দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে। 
সামর্থ্যবানরা লাখ লাখ টাকা এবং জামা-কাপড় বিতরণ করছেন। এর মধ্যে সাময়িক আনন্দ থাকলেও, দীর্ঘস্থায়ীভাবে গরিব গরিবই থেকে যায়। তাই প্রতিবছরই এই টাকার একটা অংশ দিয়ে অসহায় পরিবারকে রিকশা, ভ্যান, সেলাই মেশিন অথবা গবাদিপশু কিনে দেওয়ার মাধ্যমে যেমন দারিদ্র্য নিরসন হবে, তেমনি হ্রাস পাবে বেকারত্বও। অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় জাকাত ও ফিতরা দানের সুফল অপরিসীম।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়