ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৭ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

উদার আকাশ: সত্যনিষ্ঠতায় তুলনাহীন

আমিনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১২:২৯, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শিল্প-সাহিত্য ও প্রকাশনার জগতে পশ্চিমবঙ্গের ফারুক আহমেদ একটি সুপরিচিত মুখ। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও প্রকাশক। অধিকন্তু তিনি একজন জনপ্রিয় মিডিয়াব্যক্তিত্ব। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তিনি একজন সাহসী মানুষ। সত্যনিষ্ঠতায় তুলনাহীন। সত্য কথা বলতে এবং সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে তার নির্ভীকতা অনন্য। অনেক প্রকাশনা তার। সেসবের একটি হচ্ছে তারই সম্পাদিত ‘উদার আকাশ’ সাহিত্য ও গবেষণা পত্রিকা। এর দুটি রূপ। একটি মাসিক সাহিত্য ম্যাগাজিন। অন্যটি ষান্মাসিক গবেষণা। এটির পুরো নাম হচ্ছে ‘উদার আকাশ পিয়ার রিভিউড ষান্মাসিক দ্বি-ভাষিক রিসার্চ জার্নাল’ (‘Udar Akash’ A Peer Reviewed Half Yearly Bilingual Research Journal)।

উদার আকাশ পিয়ার রিভিউড ষান্মাসিক দ্বি-ভাষিক রিসার্চ জার্নালের ৪৭তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা সংখ্যা হাতে পেয়েছি সদ্য বিগত ১৭ ফেব্রুয়ারি। বাহক পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট কবি-গবেষক ও নদীয়াস্থ সুজন পাঠাগার ও নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ইনাসউদ্দিন। বিশাল আকৃতির একটি সমৃদ্ধতম সংখ্যা এটি। সূচিপত্র পাঠ করলেই সেটি আঁচ করা সম্ভব:

১. সার্ধশতবর্ষে শ্রদ্ধা: বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ‘শের এ বাংলা’ এ কে ফজলুল হক: মইনুল হাসান
২. সাহসী ও মানবিক ‘শের এ বাংলা’ ফজলুল হক আজও আদর্শপুরুষ বিবেচিত হতে পারেন: মোশারফ হোসেন
৩. মহামেডান ফুটবলার কৃষকবন্ধু বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক: ড. কুমারেশ চক্রবর্তী
৪. গোদি মিডিয়া, ফেক মিডিয়া: গৌকিশোর ঘোষ: সমীর ঘোষ
৫. ভারতীয় সঙ্গীত-সংস্কৃতিতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সাধনা: জয়ন্ত ঘোষাল
৬. শয়তানের শয়তানি চেনার উপায়: মহিউদ্দিন সরকার
৭. দ্বিতীয় মহসীন: দেবাশিস পাঠক
৮. সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে এক অদম্য সিপাহসালার: গোলাম রাশিদ
৯. কারার ঐ লৌহ-কবাট: ড. মহ. আসিফ ইকবাল
১০. ইতিহাসের অবিচারে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত: রণজয় মালাকার
১১. ইতিহাসের ঐতিহ্যধারায় শিক্ষাগৌরব কাজী মুহাম্মদ ইয়াসীন স্যার সৈয়দ পুরস্কার প্রাপ্তি ও ইতিহাসের পরিচয় পর্ব-পর্বান্তর: কাজী খায়রুল আনাম
১২. ভিখারিদের জন্য সংরক্ষণ চাই: হাফিজুর রহমান
১৩. অনুকরণীয় আদর্শের অভাবে বিপথগামী ছাত্র ও যুবসমাজ: মহম্মদ মফিজুল ইসলাম
১৪. কেন ‘জওয়ান’ প্রতিবাদী সিনেমা, কেন মেইন স্ট্রিমে প্রতিবাদ জরুরি?: সুমন ভট্টাচার্য
১৫. পথের পাঁচালী ও সংগীত: মধুবন চক্রবর্তী
১৬. বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রতিভাত দেশভাগের অভিঘাত: একটি বিশ্লেষণী অধ্যয়ন: চৈত্রী চক্রবর্তী
১৭. পৃথ্বীশ রাণার এক অনন্য সৃষ্টি বাদাবন: ড. সৌমিত্র মিত্র
১৮. ইবনে খালদুন ও তাঁর আল্-মুকাদ্দিমা: আজাহার হোসেন
১৯. কবি শঙ্ঘ ঘোষের জীবনে গাণিতিকসংখ্যা ‘২১’: সোনা বন্দোপাধ্যায়
২০. হাফিজ গ্যোয়েটে এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত: ড. মুহম্মদ মতিউল্লাহ
২১. মজনু শাহদের ঠাঁই হোক জাতীয় ইতিহাসের পাতায়: রফিক অনোয়ার
২২. ভারতীয় সুফি ঐতিহ্য: ড. শামিম আহমেদ
২৩. বহুকৌণিক অভীপ্সায় আমিনুল ইসলামের কবিতা: ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
২৪. নগরায়ণবাদ—নব্যনগরায়ণবাদ: ড. শান্তনু প্রধান
২৫. পরিব্রাজন তত্ত্বে নদী-ভাঙনের স্বরূপ: ড. শুভেন্দু মণ্ডল
২৬. ডা. আর আহমেদ: পূর্বাধিকার ও উত্তরাধিকার: ডা. আবু সঈদ আহমেদ।

উল্লেখিত গবেষণামূলক লেখাগুলো ছাড়াও আছে ভারত এবং বাংলাদেশের কবি-কথাসাহিত্যিকদের অনেক সংখ্যক কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণগদ্য, উপন্যাস। সব মিলিয়ে এক বিশাল আয়োজন। আমি পূর্বের কয়েকটি সংখ্যাও পড়েছি। প্রতিটি সংখ্যাই উন্নতমানের লেখায় সমৃদ্ধ। ‘উদার আকাশ’ গবেষণা জার্নালের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিকটি হচ্ছে সম্পাদকের বস্তুনিষ্ঠ মন অসাম্প্রদায়িক এবং লেখা নির্বাচনে দক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ ও ইনক্লুসিভ দৃষ্টিভঙ্গি। মহামানবিকতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে যেমন ছিলেন সর্বমানবতবাদী, উদার ও বিশ্বপ্রেমিক, উদার আকাশ তেমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রকাশিত হয়ে আসছে।

এটি দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, পৃথিবীতে আবার নতুন করে ধর্মীয় উগ্রতা ও উস্কানি মাথা চাড়া দিয়েছে। রুমি-লালন-রবীন্দ্রনাথ-ইকবাল-নজরুলদের বিশ্বপ্রেমিক অবস্থানের বিপরীতে বিভাজন ও ঘৃণাবাদকে উস্কে দেওয়া হচ্ছে। সিনেমা, নাটক, সাহিত্য সবখানেই হাত দিয়েছে সেই অশুভ তৎপরতার হাত। উদার আকাশের অবস্থান ঠিক তার বিপরীতে। বর্তমান সংখ্যার লেখাগুলো খুবই সমৃদ্ধ। সাতচল্লিশপূর্ব অবিভাজিত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শের-ই বাংলা ফজলুল হক শিক্ষার প্রসার, শোষণ-নিপীড়ন হতে কৃষকদের মুক্তকরণ, সকল পেশার নিম্নশ্রেণির মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ, সমবায় আইন প্রবর্তন ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন; যা রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাঁকে অতুলনীয় করে রেখেছে। অথচ ভারত এবং বাংলাদেশে কোথাও গুরুত্ব সহকারে তাঁকে নিয়ে আলোচনা করা হয় না। নতুন প্রজন্ম এই মহান নেতার নামটাও জানে না। বর্তমান সংখ্যায় এ মহান নেতার ওপর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি লেখা আছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে হাজী মোহাম্মদ মহসীনেরও অবদান অতুলনীয়। তাঁকে নিয়েও কোনো আলোচনা হয় না কোথাও। কাজী নজরুল ইসলাম, বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, মহাকবি ইকবাল, হুমায়ন কবির, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, গৌরকিশোর ঘোষ প্রমুখরাও উপেক্ষিত প্রায়। এমন প্রেক্ষাপটে উদার আকাশ এ ধরনের মহৎপ্রাণ মানুষদের নতুন করে আলোচনায় আলোয় এনে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচিত করে দিচ্ছে। সাহিত্য, সংগীত, সিনেমা ও নাটক ইত্যাদি নিয়ে আলোচনামূলক ও গবেষণাধর্মী লেখা ছাপানো হচ্ছে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্ব পাচ্ছে। যেমন বর্তমান সংখ্যায় শাহরুখ খান অভিনীত ‘জওয়ান’ ছবি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। অনুরূপ আরেকটি ব্যতিক্রমধর্মী লেখা হচ্ছে ‘মজনু শাহদের ঠাঁই হোক জাতীয় ইতিহাসের পাতায়’।

হাজী মোহাম্মদ মহসীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভারতে শিক্ষার প্রসারে ও উন্নয়নে ধারাবাহিক অবদান রেখে চলেছেন পশ্চিমবঙ্গের ধনবান ব্যক্তিত্ব মোস্তাক হোসেন। তাঁকে নিয়ে এই সংখ্যায় দেবাশিস পাঠক লিখেছেন, ‘দ্বিতীয় মহসীন’ এবং গোলাম রাশিদ লিখেছেন ‘সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে এক অদম্য সিপাহসালার’ শিরোনামের গদ্য। এ সংখ্যায় এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সামাজিক ভাবনা উস্কে দেওয়া ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে পথ দেখানোর মতো একটি লেখা হাফিজুর রহমানের ‘ভিখারিদের জন্য সংরক্ষণ চাই’। নতুন প্রজন্মের কাছে ‘ইতিবাচক উদাহরণ’ তুলে ধরা দরকার। কথায় আছে: Example is better than precept। উদার আকাশ সেই উদাহরণ তুলে ধরার কাজটি করে যাচ্ছে একের পর এক।

সাহিত্যকর্ম মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ও উদার আকাশের ভূমিকা ইতিবাচক অর্থে ব্যতিক্রমী। যেসব কবি-কথাসাহিত্যিক যুগের পর যুগ অন্যায় উপেক্ষার ও পরিকল্পিত অবমূল্যায়নের শিকার, তাদের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ও আলোচনা প্রকাশিত হচ্ছে উদার আকাশে। শক্তিমান অথচ অপেক্ষাকৃত কম প্রচারিত এমন কবি-কথাসাহিত্যিক-গবেষকদের সৃষ্টিকর্মকেও উপস্থাপন করা হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। বর্তমান সংখ্যায় ড. মোহাম্মদ শামসুল আলমের লেখা ‘বহুকৌণিক অভীপ্সায় আমিনুল ইসলামের কবিতা’ প্রবন্ধটি পড়ে আমি একইসঙ্গে আনন্দিত ও বিস্মিত হয়েছি। এমন সমৃদ্ধ ও এত বড় আকৃতির গবেষণা প্রবন্ধ ছাপানো হয়েছে, অথচ উদার আকাশ সম্পাদক ফারুক আহমেদ বাংলাদেশের কবি আমিনুল ইসলামকে চোখেও দেখেননি।

ড. মুহম্মদ মতিউল্লাহ রচিত ‘হাফিজ গ্যোয়েটে এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবন্ধ। সাহিত্যকে সম্যকভাবে বুঝতে পারার ক্ষেত্রে সাহিত্যের তুলনামূলক পাঠগ্রহণ জরুরি কিন্ত তুলনামূলক সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ আজকাল খুব কমই রচিত হয়। উদার আকাশ সম্পাদক ফারুক আহমেদ সেদিকে লক্ষ্য রেখেছেন। এটি হচ্ছে গুণী সম্পাদনার আরেকটি উজ্জ্বল উদাহরণ। প্রখ্যাত সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল রচিত ‘ভারতীয় সঙ্গীত-সংস্কৃতিতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য’ একটি সমৃদ্ধ প্রবন্ধ এবং বিভাজিত মনের ঘৃণাবাদে আকীর্ণ হয়ে উঠতে চাওয়া বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে খুবই সময়োপযোগী। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রতিভাত দেশভাগের অভিঘাত: একটি বিশ্লেষণ’।

এভাবে বিভিন্ন সংখ্যা নিয়ে ধরে ধরে বলতে গেলে আস্ত একখানা বই হয়ে যাবে। অতএব এখানেই থেমে যাওয়া সমীচীন। উদার আকাশ সম্পাদক ফারুক আহমেদ এবং তার পুরো টিমকে অভিনন্দন জানাই। উদার আকাশের পথচলা অনিঃশেষ হোক! জয়তু উদার আকাশ!

সর্বশেষ
জনপ্রিয়