ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৮ ১৪৩১

নানা প্রকল্পে বদলে যাওয়া চট্টগ্রাম

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭:২৪, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম। আরেকটু ভিন্নভাবে যদি বলা হয়- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ ছোট-বড় নানা প্রকল্পে বদলে যাওয়া এক শহরের নাম চট্টগ্রাম। গত এক বছরে অভূতপূর্ব উন্নয়ন দেখেছে চট্টগ্রামবাসী।

নদীর তলদেশে নির্মিত হয়েছে টানেল। ফলে এখন মাত্র তিন মিনিটেই নগরের পতেঙ্গা থেকে যাওয়া যাচ্ছে আনোয়ারা। এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত চট্টগ্রামবাসী।

গত ২৮ অক্টোবর পতেঙ্গা প্রান্তে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে টানেলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার মাধ্যমে টানেলের যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। উন্মোচিত হয় দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিল্পবাণিজ্য বিকাশের নতুন সম্ভাবনার দুয়ার।

টানেলের ফলে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগ হয়েছে আরো সহজ। চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তুলতেই কর্ণফুলী নদীর দুই পাড় ঘিরে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।

টানেলের ভেতর রয়েছে অত্যাধুনিক ফায়ার সিস্টেম। পুরো টানেল পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে একটি কন্ট্রোল রুম। যেখান থেকে টানেলের ভেতরের অবস্থা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। টানেলের ভেতর অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে তা কন্ট্রোল রুম থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। বেশি হলে সেক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ভেতরে যাবেন। এছাড়া টানেলের ভেতর কোনো গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়লে সেটি উদ্ধার করবে ফায়ার সার্ভিস।

টানেলের একপ্রান্ত আনোয়ারায় রয়েছে সিইউএফএল, কাফকো, কোরিয়ান ইপিজেড, প্রস্তাবিত চায়না ইপিজেড ও পারকি সমুদ্রসৈকত। আনোয়ারা দিয়েই বাঁশখালী, কক্সবাজার, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল এবং মীরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজীর বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের সঙ্গে যোগাযোগের লক্ষ্যেই নেয়া হয় এ টানেল প্রকল্প।

সংশ্লিষ্টদের মতে, টানেলের ফলে ত্বরান্বিত হবে কর্ণফুলী নদীর পূর্বপ্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন। পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর-বিমানবন্দরের সঙ্গেও স্থাপিত হয়েছে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা।

এছাড়া পূর্ব প্রান্তের শিল্পকারখানার কাঁচামাল ও প্রস্তুত করা মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দরসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের ফলে পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে বলে মনে করছেন তারা।

দেশের দ্বিতীয় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের পর চট্টগ্রামে আরেকটি মেগা প্রকল্প দেশের দ্বিতীয় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। গত ১৪ নভেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নগরের লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এ সড়কের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে নামকরণ করা হয় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির। আপাতত এটির বিমানবন্দর থেকে টাইগারপাস অংশ খুলে দেওয়া হয়েছে। লালখান বাজার থেকে টাইগারপাস অংশের কাজ শেষ না হওয়ায় সেই অংশ এখনই খুলে দেওয়া হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাকি কাজ সম্পন্ন করা যাবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ফলে চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ২০ মিনিটে পৌঁছানো যাবে বিমানবন্দর। চার হাজার ২৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৪ সালের জুনে।

পর্যটক বাস:

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অনন্য এক উদ্যোগ ‘পর্যটক বাস’ সার্ভিস। গত ১০ জুন থেকে দুটি বাস নিয়ে চালু হওয়া এ সার্ভিস বেশ সাড়া ফেলেছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে বাসগুলোতে যুক্ত করা হয়েছে ওয়াইফাই সংযোগ। নিরাপত্তার জন্য বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সপ্তাহের শুক্রবার ও শনিবার বাসগুলোতে পর্যটকের চাপ থাকে বেশি। এ সার্ভিসের মাধ্যমে পরিবার নিয়ে নির্দিষ্ট প্যাকেজে চট্টগ্রামের পর্যটনস্পটগুলো ভ্রমণ করতে পারেন পর্যটকরা। প্রতিদিন বিকেল ৩টা ও ৪টায় নগরের নিউমার্কেট থেকে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট ডিসি পার্ক হয়ে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে পর্যটক বাস। সন্ধ্যা ৭টা ও রাত ৮টায় পতেঙ্গা থেকে ফিরে বাস দুটি। তবে ছুটির দিনগুলোতে বিকেলের পাশাপাশি সকালেও চলাচল করে এ দুই বাস। নিউমার্কেট থেকে ফৌজদারহাট ডিসি পার্ক পর্যন্ত ভাড়া গুনতে হয় ৪০ টাকা। আর ফৌজদারহাট ডিসি পার্ক থেকে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত যেতে গুনতে হয় ৩০ টাকা।

বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় চমেকে নতুন প্রযুক্তি:

বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চালু হয় ইনট্রা ইউটেরাইন ইনসামিনেশন (আইইউআই) প্রযুক্তি। হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগে চালু হওয়া এ প্রযুক্তির ফলে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সন্তান ধারণে সক্ষম নিঃসন্তান নারীরা।

সরকারিভাবে চালু হওয়া এ প্রযুক্তিতে স্বল্প খরচে চিকিৎসা সেবা মিলছে গরিব-দুস্থ রোগীদের। এর আগে, নিঃসন্তান দম্পতিদের চিকিৎসায় ২০২১ সালে চমেক হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগে চালু হয় ‘রিপ্রোডাক্টিভ অ্যান্ড্রোক্রাইনোলজি ও ইনফার্টিলিটি’ ইউনিট। বর্তমানে আউটডোর সেবাসহ আলট্রাসনোগ্রাফি (টিভিএস), স্যালাইন ইনফিউশন সনোগ্রাফি (এসআইএস), ল্যাপারোস্ককপি, হিস্টারোস্কপি কার্যক্রম চালু রয়েছে।

বন্ধ্যাত্ব রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. তাসলিমা বেগমের তত্ত্বাবধানে এখন পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা পেয়েছেন চার হাজারের বেশি রোগী। এর মধ্যে গর্ভধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন দেড় শতাধিক। নতুন আইইউআই প্রযুক্তি চালুর ফলে এ হার বাড়বে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

অপারেশন ছাড়াই ১১ মাসে ১১০০ শিশুর জন্ম:

হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত ১১ মাসে (জানুয়ারি থেকে নভেম্বর) এক হাজার ১৪২টি প্রসব সম্পন্ন হয়েছে অপারেশন (অস্ত্রোপচার) ছাড়াই। এর মধ্যে শুধু নভেম্বরেই স্বাভাবিক প্রসব হয় ১১০ জন প্রসূতির। বলা যায়, গত এক বছরে হাজারের বেশি স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইতিহাসে অনেকটা রেকর্ড করেছে এ হাসপাতাল।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বিগত বছরগুলোতে যেখানে প্রতিমাসে গড়ে ১০ থেকে ১২টি স্বাভাবিক প্রসব হতো। কয়েক বছরের ব্যবধানে এখন প্রতিমাসে তা বেড়ে শতাধিক সংখ্যায় উন্নীত হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে জন্ম নেয় এক হাজারের বেশি নবজাতক। এছাড়াও গত এক বছরে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অর্ধশতাধিকেরও বেশি নবজাতক জন্ম নেয়।

হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. রশ্মি চাকমা বলেন, এ অঞ্চলের জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি প্রসূতিদের সেবা প্রদানে সচেষ্ট রয়েছি আমরা। এ প্রচেষ্টার ফলে বিনা অস্ত্রোপচারে গত এক বছরে এক হাজারের বেশি শিশুর জন্ম হয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এছাড়া গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা সিজারিয়ান করেও অর্ধশতাধিকেরও বেশি শিশুর জন্ম হয়েছে এ সময়ে। তবে নরমাল ডেলিভারিতেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

লোহাগাড়া উপজেলার চুনতিতে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে চালু হয়েছে দেশের প্রথম বিস্ময়কর এলিফ্যান্ট ওভারপাস। যেটির নিচ দিয়ে চলাচল করছে ট্রেন। ওপরে হচ্ছে হাতি পারাপার।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে নির্মিত এ এলিফ্যান্ট ওভারপাস দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।

দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের চুনতি, ফাঁসিয়াখালি ও মেধাকচ্ছপিয়ায় তিনটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রয়েছে। এর মধ্যে চুনতিতে স্থাপন করা হয়েছে প্রথম এলিফ্যান্ট ওভারপাস। এর উচ্চতা নয় মিটার, দৈর্ঘ্য ১০০ মিটার এবং প্রস্থ ছয় দশমিক ৮৫ মিটার।

অভয়ারণ্যগুলো হাতি চলাচলের পথ হিসেবে পরিচিত। তাই এ পথকে আকৃষ্ট করে তুলতে ওভারপাসের ওপর রোপণ করা হয়েছে প্রায় ২২ প্রজাতির গাছ। এছাড়া তৈরি করা হয়েছে লোনা পানির লেক ও দুটি আন্ডারপাস। একইসঙ্গে বন্যপ্রাণীর সুরক্ষার কথা বিবেচনায় রেখে নির্দিষ্ট দূরত্বে তৈরি করা হয়েছে সুরক্ষা দেয়াল।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরনের স্থাপনা এটিই প্রথম, যা বাংলাদেশের জন্য গৌরবের। হাতির স্বাভাবিক চলাচলে যাতে কোনো প্রকার সমস্যা তৈরি না হয়, সেলক্ষ্যে এ ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে।

চিড়িয়াখানায় জোড়া জলহস্তি:

রংপুর চিড়িয়াখানায় একজোড়া বাঘ পাঠিয়ে তার পরিবর্তে একজোড়া জলহস্তী পায় চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। গত ২১ সেপ্টেম্বর ও ১৭ অক্টোবর দুই ধাপে ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে জলহস্তি দুটি চট্টগ্রামে আনা হয়।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা সূত্র জানায়, কুমিরের আগের জায়গায় নতুন করে জলহস্তীর বাসস্থান প্রস্তুত করা হয়। কুমিরের খাঁচা স্থাপন করা হয় পাহাড়ের পশ্চিম পাশে লেকের মধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর ডা. শাহাদাত হোসেন শুভ বলেন, গত ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা থেকে একজোড়া বাঘ রংপুর চিড়িয়াখানায় পাঠানো হয়। এর বিনিময়ে দুটি জলহস্তী ‘লাল পাহাড়’ ও ‘জলপরী’কে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় আনা হয়। এর মধ্যে লাল পাহাড়ের বয়স ১২ বছর। জলপরীর বয়স ৯ বছর। চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় সর্বমোট ৬৮ প্রজাতির পশুপাখি রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৪ প্রজাতির পাখি ও চার প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী রয়েছে।

এর আগে, চলতি বছরের ১৬ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে একজোড়া সিংহ আনা হয় চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায়। একই সময় আনা হয় চারজোড়া ওয়াইল্ড বিস্ট। দরপত্রের মাধ্যমে এক কোটি ৬৯ লাখ টাকায় সিংহ, ম্যাকাও, ওয়াইল্ড বিস্ট, ক্যাঙ্গারু ও লামা আমদানি করা হয়।

সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়