ঢাকা, শনিবার   ১৮ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

বরফের রাজ্যে হারিয়ে গিয়ে যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা

মমিনুল হক রাকিব

প্রকাশিত: ১২:১৩, ২৯ জানুয়ারি ২০২৪  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা যান্ত্রিক এক শহর। ক্ষণস্থায়ী শীত মৌসুমের জানুয়ারি মাসেও ঢাকায় শীতের ছোঁয়া খুব একটা পাওয়া যায় না। তাই আগে থেকেই প্ল্যান ছিল বছরের শুরুতেই কাঁটাতারের অপরপ্রান্তের বরফের রাজ্যে ঢুঁ মেরে আসার।

প্রথমদিকে বেশ অনেকেই সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তী সময়ে শুধু আমি ও আমার বন্ধু তাহুরুজ্জামান খান অনিকই রয়ে গেলাম। বরফ ছোঁয়ার উদ্দীপনা নিয়েই শুরু হয় যাত্রা।

ঢাকা থেকে রাতের বাসে যাত্রা শুরু করি আমাদের নির্ধারিত চ্যাংড়াবান্ধা বুড়িমারী স্থলবন্দর এর উদ্দেশ্যে। সকাল ৯টায় বাস থেকে নেমেই সকালের নাশতা সেরে নেই বুড়িমারীর বিখ্যাত বুড়ির হোটেল এর ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, আলু ভর্তা ও ডাল দিয়ে।

খাবার পর্ব শেষ করে আমরা বাংলাদেশ প্রান্তের কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে পায়ে হেঁটে বর্ডার অতিক্রম করে পৌঁছে যাই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সীমান্তে। ভারত প্রান্তের কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে অবশেষে আমরা প্রবেশ করি ভারতের পশ্চিম বঙ্গে।

বর্ডার থেকেই মানি এক্সচেঞ্জ করে আমরা একটি ট্যাক্সি করে সেখান থেকে সরাসরি চলে যাই শিলিগুড়ি এসএনটি বাস স্ট্যান্ডে। আমাদের এবারের গন্তব্য সিক্কিম এর রাজধানী গ্যাংটক।

বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য সিকিমে প্রবেশ করতে একটি ইনার লাইন পারমিট প্রয়োজন হয়। এসএনটি থেকেই আমরা সেই পারমিট সংগ্রহ করি। এসএনটিতে আমাদের সঙ্গে আরও একটি বাঙালি গ্রুপ যুক্ত হয়ে। আমরা একসাথে একটি জিপ রিজার্ভ করে নেই গ্যাংটক পর্যন্ত।

দুপুরের সূর্য ঠিক তখন মাথার উপরে নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করি, পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে পরিচিত গ্যাংটক এর উদ্দেশ্যে। যারা ফেলুদা পড়েছেন তাদের কাছে গ্যাংটক শহরটা বেশ পরিচিত। সেই ছোটবেলা থেকে গ্যাংটক-দার্জিলিংয়ের গল্প পড়ে নিজের মধ্যে গড়ে তুলেছি গ্যাংটক এর এক ভিন্ন অবয়ব।

সূর্য পশ্চিম আকাশে ততক্ষণে ঢলে পড়েছে আর আমরা ছুটে চলছি তিস্তা নদীর কোল ঘেঁষে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে। ঠান্ডা তখনও খুব একটা গায়ে লাগেনি। রাত ৮টা নাগাদ আমরা পৌঁছে যাই সিক্কিম এর রাজধানী ফেলুদার গ্যাংটক শহরে।

গ্যাংটক এর প্রাণ বলা হয় এমজি মার্গকে। এমজি মার্গ এর আলোকসজ্জ্বা ও পরিচ্ছন্নতা আমাদের নজর কেড়ে নিলেও আমাদের আজ আর এই রূপ উপভোগ করার সুযোগ নেই।

আগামীকাল আমরা রওনা হয়ে সিকিম থেকে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার দূরের লাচুংয়ে। রাতেই আমরা এক এজেন্সি থেকে লাচুং ও জিরো পয়েন্টের জন্য প্যাকেজ বুক করে নিলাম। রাতটা এমজি মার্গের সঙ্গেই একটি হোটেলে কাটিয়ে দেই।

দ্বিতীয় দিন সকালে আমরা এমজি মার্গের মুসলিম হোটেলে সকালের নাশতা সেরে আমাদের নির্ধারিত জিপে যাত্রা শুরু করি লাচুংয়ের উদ্দেশ্যে। লাচুংয়ের দূরত্ব খুব বেশি না হলেও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি রাস্তা হওয়াতে সময় লাগে বেশ।

যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে কখনো খাঁড়া পাহাড়ি ঢাল আবারও কখনো আঁকাবাঁকা সর্পিল রাস্তা আমাদের যাত্রা আরও রোমাঞ্চকর করে তোলে। লাচুংয়ে প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তাই লাচুং প্রবেশের পূর্বেই আমরা আমাদের সঙ্গে থাকা পানির বোতল ডাস্টবিনে ফেলে দেই।

যাত্রাপথে আমরা বাটারফ্লাই ওয়াটারফল ও আমাদের আপন তিস্তা নদীর ভিন্ন এক রূপ দেখলাম। হিমালয় থেকে জন্ম হয়ে তিস্তা সিকিম, শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়ি হয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। আমরা তিস্তার যে রূপ বাংলাদেশে দেখে অভ্যস্ত এখানে তার পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র। সন্ধ্যা নাগাদ আমরা পৌঁছে যাই আমাদের আজকের গন্তব্য লাচুং।

লাচুং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯ হাজার ফিট উঁচুতে অবস্থিত। লাচুং এর তাপমাত্রা আমাদের সহনীয় পর্যায়ের বাইরে ছিল। রাতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল একটি কাঠের ঘরে। রাতে মাইনাস ৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায় আমাদের ঘুমানো প্রায় অসম্ভব ছিল।

প্রচণ্ড ক্লান্ত থাকা সত্বেও রাতে আমাদের ঘুম হয়নি ঠান্ডার কারণে। পরদিন সকালেই আমরা স্থানীয় একটি দোকান থেকে শীতের পোশাক ভাড়া নিয়ে নেই। তবুও শীতকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। সকালের সূর্য তখনও পূর্ব আকাশে উঁকি দিচ্ছে।

আর সেই আলো এসে পড়ছে আমাদের বারান্দা থেকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা স্বচ্ছ বরফে। আলোর প্রতিফলনের কারণে এক ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তখন।

আমাদের গাইডকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয় ইয়ামথাং ভ্যালির উদ্দ্যেশ্যে। লাচুং ভারত-চায়না বর্ডার একদম কাছাকাছি একটি গ্রাম। তাই এখানে ইন্ডিয়ান আর্মির বেশ সরব উপস্থিতি।

যাত্রা শুরুর ৩০ মিনিট এর মধ্যেই আমাদের হাতে ধরা দিতে থাকে তুলোর মত স্বচ্ছ বরফ। রাস্তা, গাছ ও পাহাড় বরফে আচ্ছাদিত অবস্থায় দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাই ইয়ামথাং ভ্যালিতে।

ইয়ামথাং ভ্যালি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২ হাজার ফুট উঁচুতে। ততক্ষণে আমাদের শ্বাস নিতে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছিলো। আমাদের সঙ্গে থাকা অক্সিজেন ক্যান থেকে কিছুটা সাহায্য নিচ্ছিলাম। ইয়ামথাং ভ্যালিতে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা আবারও যাত্রা শুরু করি লাচুং এর শেষপ্রান্ত জিরো পয়েন্ট এর উদ্দেশ্যে।

জিরো পয়েন্ট নিয়ে বেশ আগ্রহ কাজ করছিল, আবার ভয়ও লাগছিল কারণ জিরো পয়েন্ট সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫ হাজার ফুট উঁচুতে। সেখানে অক্সিজেন লেভেল মাত্রা ১১ পার্সেন্ট। জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত যাত্রাটা আমাদের জন্য বেশ রোমাঞ্চকর ছিল।

বরফে মোড়ানো পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আমরা ছুটে চলছি আবার কোথায় কোথাও বরফ জমে রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে আমরা অক্সিজেন স্বল্পতা টের পাচ্ছিলাম। মাথা ঘোরানো, বমি বমি ভাবসহ আরও বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দিচ্ছিল।

দুপুর ১টা নাগাদ আমরা পৌঁছে যাই কাঙ্ক্ষিত জিরো পয়েন্টে। জিরো পয়েন্টে একটি স্বচ্ছ পানির লেক আছে কিন্তু আমরা গিয়ে দেখি সেই লেক এর পানিও জমে বরফ হয়ে আছে। লেক এর উপরে মানুষে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও ছবি তুলছে।

বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৃষ্টি উপভোগ করলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ আর উপভোগ করতে পারিনি। ততক্ষণে শরীর বেশ খারাপ করা শুরু হয়েছে। শ্বাস নিতে পারছিলাম না ও সঙ্গে প্রচণ্ড মাথা ঘোরানো ও বমি বমি ভাব।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত উঁচুতে তাও আবার তাপমাত্রা মাইনাস এর ঘরে। সেখানে বসে কিছুক্ষণ আগুন এর তাপ নিয়ে ও নুডলস খেয়ে কিছুটা সুস্থ বোধ করলাম। ততক্ষণে আমাদের সবার শরীরই খারাপ করা শুরু হয়েছে।

গাইড তাৎক্ষণিক আমাদের গাড়িতে নিয়ে রওনা হলেন লাচুং এর উদ্দেশ্যে। ফেরার পথটা যেন শেষই হতে চাচ্ছিল না। পাহাড়ি বাঁকগুলোতে শরীর আর টিকে থাকতে পারছিলো না।

অক্সিজেন নিয়েও তখন আর কাজ হচ্ছিল না। সৃষ্টিকর্তাকে স্বরণ করতে করতে অবশেষে আমরা লাচুং এসে পৌঁছাই বিকেলে। লাচুং আসার পর সবাই কিছুটা সুস্থ অনুভব করছিলাম।

দুপুরের খাবার পর্ব শেষ করে আমরা বের হই লাচুং ঘুরে দেখতে। অপরূপ সুন্দর গ্রামটি বরফে আচ্ছাদিত। পাহাড়ের কোলে এক অনন্য গ্রাম। গ্রামের কোথাও কোনো ময়লা নেই।

এই গ্রামের প্রতিটা মানুষ তাদের গ্রামকে পরিচ্ছন্ন রাখতে বদ্ধপরিকর। লাচুং ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশ উঁচুতে হওয়াতে অল্প হাঁটাহাঁটিতেই আমরা হাঁপিয়ে যাচ্ছিলাম।

তাই কিছুটা ঘুরে ফিরে আমরা আবারও আমাদের রুমে ফিরে আসি। রুমের বারান্দায় বসে চাঁদের আলো ও আকাশ ভরা তাঁরা সঙ্গে বরফ আচ্ছাদিত পাহাড় দেখতে দেখতেই রাতটা কাটিয়ে দেই।

পরদিন সকাল ভোরেই আমরা রওনা দেই গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। ফেরার পথে সকালের সূর্যোদয় দেখি কাঞ্চনজঙ্ঘার কোল থেকে। সে এক অপরূপ দৃশ্য।

দুপুরের মধ্যে আমরা পৌঁছে যাই গ্যাংটক শহরে। বিকেল পর্যন্ত হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি গ্যাংটক ঘুরতে। গ্যাংটকের প্রাণ এমজি মার্গ এটা সত্য তবে পুরো গ্যাংটক শহরই আমাদের জন্য অনুকরণীয়।

পুরো শহরে ময়লার কোনো ছিটেফোঁটাও পাওয়া মুশকিল। এত ব্যস্ত শহর কিন্তু নেই কোনো হর্ণেএর শব্দ। অদ্ভুত না? এখানে প্রতিটা মানুষ তাদের প্রকৃতি ও আইনের প্রতি বেশ শ্রদ্ধাশীল।

শৈশবে ফেলুদার কাহিনি শুনে গ্যাংটক এর প্রেমে পড়েছিলাম ঠিকই কিন্তু সেই প্রেম শ্রদ্ধায় মিশ্রিত হয়েছে এবার স্বচক্ষে গ্যাংটক দেখে। হিমালয় কন্যা সিকিম পৃথিবীর বুকে যেনো এক টুকরো স্বর্গ।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়