ঢাকা, শনিবার   ১৮ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

লামাহাট্টা ভ্রমণে কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ আরও যা দেখে মুগ্ধ হবেন

ইসতিয়াক আহমেদ

প্রকাশিত: ১২:০৩, ৩১ জানুয়ারি ২০২৪  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

ভারত ভ্রমণে বেশিরভাগ বাংলাদেশিরাই যান দার্জিলিং আর নয়তো সিকিমের গ্যাংটক। আর এ কারণে মোস্ট কমন এই দুই ট্যুরিস্ট স্পটেই প্রায় সারা বছর ট্যুরিস্টদের আনাগোণা লেগেই থাকে। তার মাঝে এখন যেহেতু ভরা মৌসুম তাই কিছুটা ভিন্ন জায়গায় রিল্যাক্স করার প্লান থেকেই এ যাত্রায় ঘুরতে বের হওয়া আমাদের।

তাই তো আমরা বেছে নিয়েছি অফবিট ডেস্টিনেশন লামাহাট্টাকে। আমাদের জন্য নির্ধারিত হোম স্টে আগে থেকেই বুক করা আছে লামাহাট্টায়। একপাশে পাইন বন আরেক পাশে গ্রেট কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউ। আর এই দুইয়ে মিলে মিশে যে স্থান তাই লামাহাট্টা। মাল্লাগুড়ি মোড় হয়ে সেভকের রাস্তা ধরে গেলে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরত্ব লামাহাট্টার। কীভাবে লামাহাট্টা পৌঁছালাম আর থাকার জায়গা খুঁজে নিলাম তা পড়ুন- প্রথম পর্বে।

হোম স্টের আংকেল প্রথমেই বলে দিয়েছিলেন, ভোর ৫টা ৪০ মিনিটের মাধ্যেই যেন উঠে পড়ি। কারণ ৫টা ৪৬ মিনিটে সূর্যোদয়। যা কি না আমাদের রুমের বেলকনি থেকে দেখা যায়। সেই সূর্যোদয় যেন মিস না করি। ভোরের প্রথম আলো কাঞ্চনজঙ্ঘায় যখন পড়ে, তখন হালকা গোলাপি থেকে কমলা হলুদ হয়ে ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলে চোখের সামনে ধারা দেবে। যে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখার জন্য আমাদের বাংলাদেশিদের এতই না আকুতি মিনতি, সেই কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাওয়া সম্ভব এই হোম স্টে’র বেডরুম থেকেই।

লামাহাট্টার প্রথম সকাল কাঞ্চনজঙ্ঘা অসাধারণ ভিয়ের সঙ্গে গরম চা দিয়েই বেলকনিতে কাটিয়ে দিলাম। এরপর ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা করার পালা। সকালে আলুরদম, ডিম ভাজা, আর পুড়ির আয়োজন ছিল নাশতায়। এরপর বেরিয়ে পড়লাম লামাহাট্টার রূপ গিলতে। আমাদের সঙ্গে যথারীতি আছেন সঞ্জয় দাদা আর তার সুজুকি ওয়াগন। প্রথম ছুটলাম আমরা পাশের লামাহাট্টা ইকো পার্কে।

পাইনের জঙ্গলের ভেতরে গাছগাছালি, পাহাড় আর অসংখ্য ফুলের অপরূপ সমারোহ এই পার্কে। ২০১২ সাল থেকে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে উপজাতিরা হাত মিলিয়ে যত্ন করে গড়ে তুলেছে এই পার্ক। পার্কের ভেতরে আছে সুন্দর বসার জায়গা, যা ফটো প্রেমিকদের আকর্ষণ করবেই। আর আছে একটি কাঠের ওয়াচটাওয়ার। যত দূর চোখ যায় শুধুই চিরহরিৎ এর ঘন বন।

সুবিশাল পাইন গাছগুলো দম্ভের সঙ্গে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উড়ছে নানা রঙের কাপড়ের পতাকা। যাকে বলা হয় প্রেয়ার ফ্লাগ। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই পতাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বাতাসে চারপাশের পরিবেশ ও মানুষের মন পবিত্র হয়।

বাগানের একবারে উপরে যাওয়ার জন্য জঙ্গল কেটে আঁকাবাঁকা রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। পাহাড়ি রাস্তায় ট্রেকের অ্যাডভেঞ্চারের লোভ সামলানো দায়। চূড়ায় পৌঁছে দেখা যাবে সুন্দর একটি লেক। গ্রামবাসীদের কাছে এটি খুব পবিত্র। এখানকার জনজীবন বড়ই সরল, ও কোলাহল বর্জিত। দেখলেই মন-প্রাণ ভরে যায়। কত সামান্য জিনিসেই এরা খুশি থাকে আর নিজেদের মধ্যে এদের প্রচন্ড একতা। সব থেকে উপভোগ্য এখানকার সকাল আর রাতগুলো।

পাইন ফরেস্টের ভেতরেই পবিত্র লেকের অবস্থান। যদিও ৭৫০ মিটারের পথ মাত্র। তবে খাড়া উঠতে গিয়ে দম যায় যায় অবস্থা হয় অনেকেরিই। যদিও শর্টকাট এ রাস্তা ছেড়েই সরাসরি ওঠা সম্ভব। তবে এখানে শটকার্ট ব্যবহারের কথার আছে নিষেধাজ্ঞা।

লামাহাট্টার এই পবিত্র লেক নিয়ে প্রচলিত আছে কিছু গল্প, মূলত বুদ্ধিস্ট মিথিউলজি অনুযায়ী জলাধার জিনিসটিই বৌদ্ধের এক প্রকার আশির্বাদ। মূলত এখানে আগে দুটি ভিন্ন পুকুর ছিল। আর দুটো পুকুরেই ছিল দুটো রাজহাঁস। সেগুলো পুকুরের এতটাই যত্ন নিত, যে একটি পাতাও পড়তে দিত না পুকুরের পানিতে। হঠাৎ একদিন গ্রামবাসী দেখে একটি রাজহাঁস নেই।

একই সঙ্গে পুকুরে পানিও নেই। এভাবেই হঠাৎ করেই রাজহাঁসগুলো হারিয়ে যায়, আর পুকুরও পানিশুন্য হয়ে যায়। অনেক উঁচুতে অবস্থান আর চারপাশেই উঁচু পাহাড় থাকার পরেও পুকুরগুলোতে আর পানি জমে না। পরবর্তী সময়ে কৃত্রিমভাবে একটি পুকুরে পানি রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এটিই সেই পবিত্র পুকুর লামাহাট্টার।

এখানকার একটি বিরলতম আকর্ষণ হলো দুষ্প্রাপ্য সব অর্কিড। এখানকার পরিবেশেই নাকি দুষ্প্রাপ্য অর্কিড সৃষ্টির রহস্য। অর্কিড দেখতে হলে যেতে হবে নভেম্বর মাসে। ইকো পার্ক ঘুরেই পাহাড়ের রূপ গিলতে গিলতে বেড়িয়ে পড়লাম আমরা। দুপুরের রোদ আর ঠান্ডা বাতাস সব মিলেমিশে একাকার।

এবার ছুটলাম পেশকের টি গার্ডেনের পথে। দার্জিলিং টি এর বিখ্যাত অনেক বাগানই এই পেশকজুড়ে। দূরে সিকিম আর কাঞ্চনজঙ্ঘা আর চা বাগান। টি গার্ডেন ঘুরে আবারও পথ ধরা। এবার চলছি একটি রোমান্টিক জায়গায়। অন্তত আমার কাছে এটিই এ অঞ্চলের সবচেয়ে রোমান্টিক স্পট মনে হয়েছিল। কারণ সেখানে একটি ভিউ পয়েন্ট আছে, যার নাম লাভারস মিট ভিউ পয়েন্ট।

মূল গেইটের মধ্যে কথাটি লেখা। ধারণাটি চমৎকার! প্রেমিক-প্রেমিকারা সেখানে নিজেরা দেখা করবেন ওওই ভিউ পয়েন্ট উপভোগ করবেন। জায়গাটির নামটিও অবশ্যই রোমান্টিক- ত্রিবেনি। সহজ বাংলায় বলা চলে তিন বেণীর সমাহার। এখানে নদীকে মূলত বিনুনীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

লামাহাটা থেকে এটি মাত্র ৪ কিলোমিটার পূর্ব দিকে। ত্রিবেনী জায়গাটি পড়েছে কালিম্পং এর মধ্যে। পশ্চিম থেকে এটিকে কালিম্পং এ প্রবেশদ্বার বলা চলে। একদিকে সিকিম থেকে এসেছে তিস্তা। অন্যদিক থেকে গভীর বন পেরিয়ে স্বচ্ছ পানি নিয়ে এসেছে রাঙ্গিত। কাঞ্চনজঙ্ঘার নিচের কাবরু পর্বতের একটি গেইসার বা উষ্ণ প্রস্রবন থেকে রাঙ্গিতের উৎপত্তি। এরা ত্রিবেণীতে মিলিত হয়ে ভাটিতে বয়ে গেছে তিস্তা নামে।

সবুজে মোড়া রহস্যময় ঘন বন। তার ফাঁক গলে সুউচ্চ পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা যুগল স্রোতস্বিনী এখানে করেছে আলিঙ্গন। তারপর জলপরীর মতো বয়ে গেছে হাজারও মাঠ পেরিয়ে। লাভার্স মিট পয়েন্ট ঘুরে চললাম গুমবাদারা ভিউ পয়েন্ট দেখতে। চা বাগানের মাঝে দিয়েই একে বেঁকে উঠে গেছে যে পথ।

সবুজ পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই গ্রাম যদিও এখনও সুপ্ত ডেস্টিনেশন হিসেবেই রয়ে গেছে টুরিস্টদের কাছে। তবে বর্তমানে জনবহুল টুরিস্ট স্পটগুলোর বাইরে এমন নির্জন লোকেশনে ঘুরে বেড়ানোর প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় হয়তো অদূর ভবিষ্যতে তাকদাই হয়ে উঠবে এক পরিচিত টুরিস্ট ডেস্টিনেশন।

‘তাকদা’ বা স্থানীয় ভাষায় ‘তুকদা’ কথার অর্থ হলো ‘মেঘে ঢাকা’। বস্তুত পক্ষেই পাহাড়ি ঢালে মেঘে ঢাকা সবুজে মোড়া এই হ্যমলেট। দার্জিলিং জেলার সুদৃশ্যতম চা বাগানগুলোর সন্ধান মিলবে এই তাকদাতেই। পাহাড়ি পথে, সবুজ ঘেরা চা বাগানের মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

ঘুরাঘুরি শেষে আবারও ফিরলাম হোম স্টেতে। ফিরেই ভাত, পাপড়, সবজি ও ডিম ভুনা দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। এরপর পালা খানিকটা বিশ্রামের। বিগত কয়েকদিন ধরে লাগাতার দৌড়ের উপরেই আছি আমরা। দিনে আলো নিভে আসার সঙ্গে সঙ্গে দিনের শেষ আলোতে আবারও বেলকনিতে বসেই কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।

সন্ধ্যায় গরম চা আর সঙ্গে আয়োজন করা হলো গরম গরম মোমোর। স্কোয়াস নামে এক পাহাড়ি সবজি দিয়েই বানানো যে ভেজিটেবল মোমো। আন্টি আর সেই মুসলিম আপু মিলেই আমাদের সামনে বানালো সেই মোমো। অসাধারণ যার স্বাদ।

আজ যেন একটু বেশিই ঠান্ডা পড়েছে। তাই সন্ধ্যায় বের হওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও বাদ দিলাম। আশপাশের দোকানপাটও বন্ধ হয়ে গেছে ততক্ষণে। তাই সন্ধ্যায় নিজেরাই আড্ডা দিলাম। অতঃপর ডিনারে ছিল ভাত, বেগুনের সবজি, পাপড়, ডাল আর মুরগির মাংস। এবার অপেক্ষা সকাল হওয়ার।

কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে রাখুন-

>> ঢাকা হতে শিলিগুড়ি বাস ভাড়া ২০০০ টাকা
>> শ্যামলী পরিবহন শিলিগুড়ি বাস কাউন্টারের ফোন নম্বর (+91 9153037970)
>> গাড়ি ড্রাইভার সঞ্জয় দাদার নম্বর (+91 7029283482)
>> গ্রিন ভিউ হোম স্টে, লামাহাট্টার নম্বর (+91 8972195314)

গাড়ি, বাস বা হোম স্টে বুক দিতে সরাসরি ফোন কিংবা হোয়াটস অ্যাপে নক দিতে পারেন।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়