ঢাকা, সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

উজান-ভাটির মিলিত ঐশ্বর্যে বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতির এক সমৃদ্ধ জেলা কিশোরগঞ্জ

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৬:৪৯, ১৯ মার্চ ২০২৪  

উজান-ভাটির মিলিত ঐশ্বর্যে বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতির এক সমৃদ্ধ জেলা কিশোরগঞ্জ

উজান-ভাটির মিলিত ঐশ্বর্যে বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতির এক সমৃদ্ধ জেলা কিশোরগঞ্জ

উজান-ভাটির মিলিত ঐশ্বর্যে বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতির এক সমৃদ্ধ জেলা কিশোরগঞ্জ। ১৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত ঢাকা বিভাগের এই জেলা অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি বহন করছে। মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাস, তার কন্যা বাংলা ভাষার মধ্যযুগীয় নারী কবি চন্দ্রাবতী, বীর কেশরী মসনদে আলা ঈশা খাঁ, বাংলা শিশু সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী এবং তার পুত্র সুকুমার রায়ের স্মৃতিধন্য আজকের কিশোরগঞ্জ। ইতিহাস-সমৃদ্ধ দর্শনীয় স্থানগুলোর বাইরেও হাল আমলে এখানে আরও কিছু পর্যটন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। রেল ও সড়ক উভয় পথেই সহজে যোগাযোগ থাকায় প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী ও পর্যটক এখানে এসে মানসিক পরিতৃপ্তি লাভ করছেন। কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলের দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন স্পটগুলো সম্পর্কে এবারে সংক্ষেপে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।উন্নত যোগাযোগব্যবস্থায় কিশোরগঞ্জের হাওর এখন ভ্রমণপিপাসুদের নতুন ঠিকানা।

কিশোরগঞ্জ জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম। এই তিন উপজেলাকে বর্তমান সরকার পরিপূর্ণ হাওর উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর বাইরে নিকলী উপজেলার অধিকাংশ এলাকাও হাওর হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া করিমগঞ্জ, তাড়াইল ও বাজিতপুর উপজেলার অংশবিশেষও হাওরের অন্তর্ভুক্ত। একসময় হাওরবাসীর মুখে মুখে একটি কথা প্রায়শই প্রবাদ বাক্যের মতো উচ্চারিত হতো ‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও’। অর্থাৎ বর্ষাকালে হাওরবাসীর একমাত্র যোগাযোগমাধ্যম ছিল নৌকা, আর শুকনো মৌসুমে পায়ে হাঁটা মেঠো পথ। সেই চির অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ হাওরের মানুষ কখনও ভাবেনি তাদের ঘরেও একসময় বৈদ্যুতিক আলো জ্বলবে, অথবা তাদের এলাকায়ও চলবে যান্ত্রিক বাহন। সেই অসম্ভব স্বপ্নই আজ তাদের জীবনে বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে। আজ হাওরের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের ঝলকানি, কর্দমাক্ত মেঠো পথগুলো হয়েছে কংক্রিট বিছানো পাকা সড়ক। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তাদেরই ভূমিপুত্র, সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

প্রথমে শুকনো মৌসুমে চলাচলের জন্য পুরো হাওরে স্থাপন করা হয় সাব-মার্জিবল বা ডুবো সড়ক। বর্ষায় সড়কগুলো পানির নিচে ডুবে যেত। শুকনো মৌসুমে আবার ভেসে উঠত। এসব সড়কে বছরের ছয় মাস চলাচল করা গেলেও বাকি ছয় মাস ইঞ্জিনচালিত ট্রলারই হতো একমাত্র ভরসা। তাই সাবেক রাষ্ট্রপতি হাওর অঞ্চলকে সারা বছর সহজ যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায় আনার জন্য অল-ওয়েদার সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। মূলত তার স্বপ্নের পথ ধরেই পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম উপজেলাকে সড়ক যোগাযোগের আওতায় আনার জন্য এই অল-ওয়েদার সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করে। ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল সাবেক রাষ্ট্রপতি ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষে এই মেগা প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন করেন। ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ নান্দনিক সড়কটি এখন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় ও নয়নাভিরাম স্পটে পরিণত হয়েছে। হাওরের স্বাভাবিক জলধারা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সড়কে ৫৯০.৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসি গার্ডার, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, ২৬৯.৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া নির্মিত সড়ককে পানির প্রবল তোড় ও ঢেউ থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সাড়ে সাত বর্গকিলোমিটারেরও অধিক স্থানে সড়কের দু’পাশে সিসি ব্লকের স্লোপ প্রটেকশন দেওয়া হয়েছে। সড়কের ভাতশালা এলাকায় ২৬১.৮১ মিটার সেতু, ঢাকী এলাকায় ১৭১.৯৬৪ মিটার সেতু এবং ছিলনী এলাকার ১৫৬.৭২ মিটার সেতু সড়কটির সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই সড়কটি ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে পরিণত হয়। হাওরের বিশাল জলরাশি ভেদ করে নির্মিত হওয়ায় সড়কটিকে মনে হয় সাগরের ওপর ভাসমান ঝুলন্ত এক আশ্চর্য স্থাপনা। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ এখানে ছুটে আসে। ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের সঙ্গে সহজ যোগাযোগের এই অল-ওয়েদার সড়কের পর্যটন সম্ভাবনা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

মিঠামইন উপজেলার আরেক ঐতিহাসিক নিদর্শন হচ্ছে বিথঙ্গলের আখড়া। স্থানীয়ভাবে এটি দিল্লির আখড়া নামে পরিচিত। মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর এই আখড়া নির্মাণ করেছিলেন বলে এর আরেক নাম হয় দিল্লির আখড়া। আখড়ার পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীতীরে ঘন হিজল গাছের সারি, প্রাচীন দেয়াল, অট্টালিকা ও ভেতরের নয়নাভিরাম পরিবেশ পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে। এখানকার নান্দনিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য প্রতি বছর দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা ছুটে আসে। এ ছাড়া মিঠামইন উপজেলায় বেসরকারি উদ্যোগে ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’ নামের উন্নতমানের আবাসিক হোটেল নির্মিত হওয়ায় পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার অনেক সুবিধা হয়েছে। অন্যদিকে মোগল শাসনামলের জয়নশাহী পরগনার সায়র জলকর মহালের প্রধান ও ঈসাখাঁর সমসাময়িক দেওয়ান মজলিশ দেলোয়ার খাঁ ইটনা থানা সদরের কাছে দেওয়ান বংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হাওরের এই জনপদের দেওয়ান বাড়িটি এখনও পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে। ইটনার দেওয়ানদের উত্তর পুরুষ দেওয়ান গোলাম হায়দার খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতকে অষ্টগ্রাম থানা সদরে তার জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। অতীতের সেই জৌলুস আজও অষ্টগ্রামের দেওয়ান বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়। অষ্টগ্রাম থানা সদরে প্রায় ৪০০ বছর পূর্বে সুলতানি আমলের নকশায় নির্মিত দৃষ্টিনন্দন কুতুব মসজিদ দেখার জন্য এখনও দূর-দূরান্তের পর্যটকরা ছুটে আসেন। অষ্টগ্রাম উপজেলার পনিরের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না।

নিকলী থানা সদরে হাওরের কোল ঘেঁষে নির্মিত বেড়িবাঁধ ইতোমধ্যে অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। উপজেলার ছাতিরচর গ্রামে অবস্থিত করচ বন বর্ষা মৌসুমে অসাধারণ নান্দনিকতা সৃষ্টি করে। প্রতি বর্ষা মৌসুমে নিকলীর বেড়িবাঁধ এবং করচ বন ঘুরে দেখার জন্য সারা দেশ থেকে শত শত দর্শনার্থী এখানে ছুটে আসেন।

ইটনা, অষ্টগ্রাম ও মিঠামইনের উন্নয়ন কার্যক্রম বেগবান হওয়ায় এবং এখানে সড়ক ও বিভিন্ন রকম স্থাপনা তৈরি হওয়ায় ইতোমধ্যে এই হাওর এলাকাটিতে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। কিশোরগঞ্জের মরিচখালী এলাকা থেকে মিঠামইন পর্যন্ত হাওরের ওপর দিয়ে উড়াল সেতু নির্মাণের কার্যক্রমও শুরু হয়ে গেছে। উড়াল সেতু নির্মাণের পর এই তিন উপজেলা আরও আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠবে। সে কারণেই আগামী দিনে এই হাওর অঞ্চলে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বর্ষা মৌসুমে স্থানীয় জলজীবী কিছু মানুষ ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ট্রলার, স্পিডবোট হাওরে নামিয়ে পর্যটকদের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে নিয়ে যান। এতে করে ওই সকল পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যও ফিরে এসেছে। সুপরিকল্পিতভাবে যদি হাওরকে নিয়ে আরও কিছু উদ্ভাবনী চিন্তা করা যায় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চল পর্যটনের এক সোনালি দ্বার উন্মোচন করবে।

সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়