ঢাকা, সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

ফরিদপুরে এবার ৩০০ কোটি টাকার পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের আশা

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৫:৫০, ১৬ মার্চ ২০২৪  

ফরিদপুরে এবার ৩০০ কোটি টাকার পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের আশা

ফরিদপুরে এবার ৩০০ কোটি টাকার পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের আশা

১০ বছর আগে দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ বীজের চাষ করেন লাভলী আক্তার ও ইনতাজ মোল্লা দম্পতি। এরপর ভালো লাভ পেয়ে প্রতিবছরই বাড়িয়েছেন আবাদি জমির পরিমাণ। এবার তারা ৪০ বিঘা জমিতে এই পেঁয়াজের বীজের আবাদ করেছেন। যা থেকে কোটি টাকার লাভের আশা করছেন তারা। 

কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজে দিনবদলের এমন গল্প এখন দোলা তুলছে ফরিদপুরের ফসলি মাঠে। কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এবছর ফরিদপুর জেলায় পেঁয়াজ বীজের উৎপাদন ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তবে ভারত থেকে পেঁয়াজ বীজের আমদানি ঠেকানো না গেলে কৃষককে মার খেতে হবে বলেও আশঙ্কা করছেন পেঁয়াজ বীজ চাষিরা।

পেঁয়াজ বীজ চাষ করে অভাবনীয় সাফল্য পাওয়া লাভলী আক্তার ও ইনতাজ মোল্লার বাড়ি ফরিদপুরের অম্বিকাপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে। নুন আনতে পান্তা ফুরাতো এক সময় তাদের। কিন্তু এখন এই পরিবার কোটিপতি। নিজস্ব জমিতে তাদের পাকা ইমারতে বহুতল ভবনে যেমন জৌলুস বেড়েছে, তেমনি জীবনযাপনে এসেছে ঊর্ধ্বমুখি পরিবর্তন। 

দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছেলে আর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া একটি মেয়ে নিয়ে এখন তাদের ব্যয়বহুল সংসার। যা এই কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজের বদৌলতে তাদের কাছে ধরা দিয়েছে। প্রতিবছর তারা উপার্জনের টাকায় নিজেদের স্থাবর সম্পত্তিও বাড়াতে পারছে। নতুন করে কিনছে জায়গাজমি।

জীবন বদলে যাওয়ার মতো এই অনুপ্রেরণার গল্প জানা যায় লাভলি আক্তারের মুখেই। তিনি বলেন, বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসে দেখি শ্বশুর বাড়ির লোকেরা পেঁয়াজ বীজের চাষ করছেন। তিনিও স্বামীকে সহায়তায় নামেন। এতে প্রথম বছরেই ভালো আয় হয় তাদের। এরপর আর থেমে থাকেননি। 

লাভলী আক্তার বলেন, পেঁয়াজ বীজের টাকা দিয়ে ৭৫ লাখ টাকা খরচ করে বাড়িতে বিল্ডিং দিয়েছি। প্রতিবছরই নতুন জমি কিনছি। এক সময় যা ছিলো অকল্পনীয়, এখন তাই বাস্তব আমাদের কাছে।

লাভলী জানান, আবহাওয়া ভালো থাকলে এবার তারা বিঘা প্রতি দুই থেকে আড়াই মণ পেঁয়াজ বীজ পাবেন বলে আশা করছেন। প্রতি বিঘা জমিতে এই বীজের আবাদ করতে এক লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়। সেই হিসাবে সবমিলিয়ে তাদের এবার প্রায় কোটি টাকার মতো লাভ থাকবে বলে তারা আশা করছেন।

পেঁয়াজ বীজ গাছের সাদা কদম তথা গোলাকারের বড় ফুল শুকিয়ে বের হয় কালো দানা বা বীজ। আকাশ ছোঁয়া বাজার দরের কারণে একে বলা হয় কালো সোনা। একটা সময় পুরোপুরি আমদানি নির্ভর থাকলেও দিনে দিনে দেশে এই কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজের আবাদ বাড়ছে। দেশের পেঁয়াজ বীজের মোট চাহিদার ৫০ শতাংশ উৎপাদন হয় ফরিদপুরে। চলতি মৌসুমে এ জেলার চাষীদের সবমিলিয়ে পেঁয়াজ বীজের উৎপাদন প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও প্রাকৃতিক পরাগায়নের অভাবে এবার আবাদের তুলনায় পেঁয়াজ বীজের উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাওয়ার তীব্র আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। সরেজমিন কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে ও কৃষি দফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে এ তথ্য।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি মৌসুমে ফরিদপুর জেলার ৯টি উপজেলায় পেঁয়াজ বীজের আবাদ হয়েছে ১৮শ ৯০ হেক্টর জমিতে। যা থেকে প্রায় সাড়ে ৭ মেট্রিকটনেরও বেশি পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে এবার। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে জেলা সদরে প্রায় ২০৮ হেক্টর জমিতে। এরপরে ভাঙ্গায় ১৭৬, সদরপুরে ১৪৬, চরভদ্রাসনে ৬৮, মধুখালীতে ৬৮, বোয়ালমারীতে ৩৪, নগরকান্দায় ২৮, সালথায় ২২ ও আলফাডাঙ্গায় ৬ হেক্টর জমিতে এবার পেঁয়াজ বীজের আবাদ করা হয়েছে। 

গত বছর ফরিদপুর জেলায় ১ হাজার ৮৬৭ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ বীজের আবাদ করা হয়েছিলো। গতবারের তুলনায় এবছর আবাদের পরিমাণ বেড়েছে। ভালো লাভ পাওয়ায় এই ফসলের দিকে কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে। তবে এবছর মৌমাছির অভাবে এই পেঁয়াজ বীজের গাছে পরাগায়নের মাত্রা কমে এসেছে। নিরুপায় কৃষক হাতের তালু বুলিয়ে এক ফুলের রেণুর সঙ্গে আরেক ফুলের রেণুর পরাগায়নের পন্থাও বেছে নেন অনেক ক্ষেতে। কিন্তু এতে প্রাকৃতিক পরাগায়নের মতো ভালো ফলন হয়নি। আর তাই গত বছরের চেয়ে কিছু বেশি জমিতে চাষ হলেও এবার গতবারের চেয়ে উৎপাদন কমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সুযোগে ভারত থেকে পেঁয়াজ বীজ আমদানিরও আশঙ্কা রয়েছে। 

কৃষকেরা জানান, ভারত থেকে পেঁয়াজ বীজ আমদানি করা হলে তা সার্বিকভাবেই ক্ষতি ডেকে আনবে। কারণ, ভারত থেকে আনা পেঁয়াজ বীজ নিম্নমানের। তাতে ভালো ফলন হয় না।

পেঁয়াজ বীজ আবাদে ছোট্ট শিশু প্রতিপালনের মতোই যত্নশীল থাকতে হয়। কোনো রকম অযত্ন হলে ফলন নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষেতে বীজের আবাদ শুরু হয় নভেম্বর-ডিসেম্বরে আর ফলন পাওয়া যায় এপ্রিল-মে মাসের দিকে। ক্ষেত থেকে তোলার পর একবছর এই বীজ সংরক্ষণ করতে হয়। কারণ পরবর্তী বছরে গিয়ে কৃষকরা এই বীজটি সংগ্রহ করে ক্ষেতে বপন করে। কালো সোনা খ্যাত এই পেঁয়াজ বীজের চাষাবাদ করে জীবনের গল্প বদলে নিয়েছেন ফরিদপুরের দরিদ্র কৃষকেরা। তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করতে পেরেছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কৃষকদের স্বার্থে কৃষকদের সুযোগ-সুবিধার দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে এমনটিই প্রত্যাশা পেঁয়াজ বীজ চাষিদের।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন,  দাম ভালো পাওয়ায় এ বছর আমাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি পেঁয়াজ বীজের আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া ঠিক থাকলে জেলার কৃষকরা এবার সাড়ে ৭ মেট্রিকটন বীজ উৎপাদন করবে। যার বাজার মূল্য কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

তিনি বলেন, ফরিদপুর জেলার পেঁয়াজ বীজ চাষিদের সমস্যা নিরসনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর তাদের সব ধরনের পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহায়তা করে আসছে। এতে তারা দিনে দিনে উন্নতি করতে পারছে এ সেক্টরে।  

সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়